হামলাকারীর প্রতি নয়, ব্রেনওয়াশকারীদের প্রতি ক্ষোভ আছে: জাফর ইকবাল
হামলাকারী ফয়জুল হাসানের প্রতি নয়, বরং যারা তাঁকে ভুল বুঝিয়ে ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে, তাদের প্রতি ক্ষোভ আছে বলে জানিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাঁকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে তিনি এ কথা বলেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মুহম্মদ জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। রায়ে ফয়জুল হাসান নামের এক আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া একজনকে চার বছরের কারাদণ্ড ও বাকি চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুহাম্মদ নূরুল আমীন বিপ্লব এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, ওই ছেলেটার (ফয়জুল হাসান) ওপরে আমার কোনো রাগ নেই। কাজেই তাঁর শাস্তি হয়েছে, সে জন্য আমি আনন্দিত, এ ধরনের কোনো ফিলিংস আমার ভেতরে নেই। বরং বলা যেতে পারে, তাঁর প্রতি আমার করুণা আছে, মায়া আছে। ওরা এমনই মানুষ, সে জানে যে আমাকে কিংবা আমার মতো একজনকে মার্ডার (খুন) করলে বেহেশতে যাবে। এ ধরনের একটা জীবন থাকার তো কোনো মানে হয় না। এ ধরনের একটা বিশ্বাস নিয়ে থাকার মানে হয় না।’
মুহম্মদ জাফর ইকবাল আরও বলেন, ‘যারা এই ছেলেগুলোকে (ফয়জুল) এ ধরনের বিশ্বাসে নিয়ে এসেছে, এ ধরনের একটা অন্যায় করার জন্য, ওদের প্রতি আমার ক্ষোভ আছে। এটা কেমন করে সম্ভব যে মানুষ ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এ ধরনের ছেলেদের ভুল রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছে। এখন এই ছেলেটা সারা জীবন জেলখানায় কাটাবে। অথচ যারা তাকে বুঝিয়ে এসব কাজের জন্য নামিয়ে দিয়েছে, তাদের কিছুই হবে না। এ নিয়ে আমার ভেতরে ক্ষোভ আছে।’
রায় ঘোষণার সময় মুহম্মদ জাফর ইকবাল আদালত চত্বরে ছিলেন না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পরে তিনি ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। এখন তিনি ঢাকাতেই আছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফয়জুল হাসানকে যারা ব্রেনওয়াশ করে ভুল পথে নিয়ে এসেছে, তারা আড়ালে থাকছে, তারা চিহ্নিত হচ্ছে না। অথচ মাঝপথে একটা ছেলের সারা জীবন নষ্ট হয়ে গেল।’
এর আগে ২০১৮ সালের ৩ মার্চ বিকেলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালানো হয়। তখন মুহম্মদ জাফর ইকবাল মাথা ও ঘাড়ে ছুরিকাহত হন। হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থী ও পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থল থেকে ফয়জুল হাসানকে আটক করেন।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে সিলেটের জালালাবাদ থানায় মামলা করেন। মামলায় ফয়জুলকে প্রধান আসামি করা হয়। পাশাপাশি ফয়জুলের বন্ধু মো. সোহাগ মিয়া, বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফয়জুল হক ও ভাই এনামুল হাসানকে আসামি করা হয়।
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। তার আগে ২৬ জুলাই ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম। গত ১০ মার্চ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। মামলায় ৫৬ সাক্ষীর মধ্যে ৩৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। গত ২১ ও ২২ মার্চ যুক্তিতর্ক শেষে সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ নুরুল আমীন বিপ্লব রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করেন। আজ সেই মামলার রায় দেওয়া হলো।
সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি মমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি ফয়জুল হাসান সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কালিয়ারকাপন গ্রামের বাসিন্দা। তাঁকে ২০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। মামলায় ফয়জুলের বন্ধু একই উপজেলারর উমেদনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. সোহাগ মিয়াকে চার বছরের কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বর্তমানে তাঁরা কারাগারে। এ ছাড়া মামলার বাকি চার আসামি ফয়জুলের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফয়জুল হক ও ভাই এনামুল হাসানকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রায় ঘোষণার সময় আদালত পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন, যেসব লেখক মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান, সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে লেখেন বা বক্তব্য দেন, তাঁদের মধ্যে ভয়, শঙ্কা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকেই মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর নৃশংস ও বীভৎস হামলা চালানো হয়।