সৌন্দর্য ছাপিয়ে চিন্তার ছাপ গোলাপ গ্রামে
‘গ্রাম’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ফসলের খেত, ছোট ছোট ঘর, বাড়ির সামনের উঠানে লাউয়ের মাচা, বাড়ির পাশে জমিতে নানান সবজির চাষ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এ যেন এক ভিন্ন গ্রাম।
মাইলের পর মাইল বসতবাড়ি, স্কুল, বাজার—যেখানেই চোখ পড়ে, শুধু গোলাপ আর গোলাপ। গোলাপের আধিপত্যে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের নাম লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে পরিচিতি পেয়েছে ‘গোলাপ গ্রাম’ হিসেবে।
এসব গ্রামের মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস এখন এই গোলাপ ফুল। গোলাপের পাশাপাশি জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, ক্যালেন্ডুলা, গাঁদা প্রভৃতি ফুলের চাষও হয় এখানে। তবে করোনার কারণে বিধিনিষেধ ও বাগানে ছত্রাকের প্রাদুর্ভাবে সাভারের প্রায় ১০০ কোটি টাকার এই ফুলের বাজার নিয়ে বেশ চিন্তিত ফুলচাষিরা।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর থাকে গোলাপ গ্রাম। ব্যস্ত শহুরে জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে অনেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চলে যান গোলাপের রাজ্যে। বাগান থেকে যেমন টাটকা ফুল কেনা যায়, তেমনি স্থানীয় শ্যামপুর ও মৈস্তাপাড়ায় গড়ে ওঠা রাতের ফুলের বাজার থেকে স্থানীয় ফড়িয়ারা ফুল কিনে সরাসরি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করেন। বিভিন্ন উৎসবের ওপর ভিত্তি করে সাধারণত বাগান ও স্থানীয় বাজারে গোলাপের দাম ২ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক থেকে গোলাপ গ্রাম সম্পর্কে জেনে রাজধানীর তেজগাঁও থেকে পরিবারের সঙ্গে গতকাল শুক্রবার সকালে গোলাপ গ্রামে ঘুরতে এসেছিলেন সানজিদা সিকদার। বাগান থেকে টাটকা ফুল কিনে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সেজেছেন কামরুন নাহার। গোলাপ ফুলের বাগানে নিজেদের সুন্দর মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে দেখা যায় তাঁদের। সানজিদা সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, শীতের শিশিরভেজা লাল গোলাপ—চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো একটি দৃশ্য। এ অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ!
তবে এবার ফুলের বেচাকেনা কেমন হবে, তা নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সাভার উপজেলার কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাভারের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। বিরুলিয়া ইউনিয়নে ২০০ থেকে ২২০ হেক্টর জমিতে এবং বনগাঁও ও ভাকুর্তা ইউনিয়নের বেশ কিছু জায়গায় ফুলের চাষ হচ্ছে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বড় অঙ্কের বাণিজ্যের আশা করছিলেন ফুলচাষিরা। সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিধিনিষেধ আরোপের কারণে এসব অনুষ্ঠান উদ্যাপন নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি বাগানে ছত্রাকের প্রাদুর্ভাবে চিন্তিত চাষিরা।
ফুলচাষি মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কয়েকটি বাগানের ফুলগাছের পাতা ও ফুল নরম হয়ে ঝরে পড়ছে। এর আগেও এমন হয়েছিল, তবে সে সময় কীটনাশক ব্যবহার করার পর ধীরে ধীরে তা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এবার কাজ হচ্ছে না। আছে করোনার বিধিনিষেধ। সব মিলিয়ে ফুল বিক্রি হবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি সব ঠিক থাকলে ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করা সম্ভব হবে। গত বছর ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছিল। করোনার সময় চাষিরা যেন ঢাকায় ফুল নিয়ে যেতে পারেন, সে জন্য বিশেষ পরিবহনের ব্যবস্থা করা হবে।’ ছত্রাকের আক্রমণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ২০১৭ সালেও এমন হয়েছিল। আমরা ইতিমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি এবং কৃষকদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছি। একটু গরম পড়লে এ সমস্যা চলে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের ঋণের বিষয়ে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’