‘সেই রাতে ত্রাতার ভূমিকায় ছিলেন দিয়াকুল গ্রামের মানুষ’

আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চ অভিযান–১০
ফাইল ছবি

ঝালকাঠিতে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের সময় যাত্রীদের উদ্ধার ও সাঁতরে তীরে আসা যাত্রীদের গরম পোশাক দিয়ে পাশে দাঁড়ান সদরের দিয়াকুল গ্রামের মানুষ। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে লঞ্চে আগুন লাগার পরপরই এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা কুয়াশা আর প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে সুগন্ধা নদীতে ঝাঁপ দেন যাত্রীদের বাঁচাতে।

এলাকাবাসীর ভাষ্য, ঘটনার পরপরই দিয়াকুলের লোকজন জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ কল করেন। তবে তাঁরা সহায়তা পাননি। ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে সকালে। কিন্তু গ্রামের লোকজন রাতেই উদ্ধারকাজে হাত লাগান। অনেকেই ট্রলার নিয়ে লঞ্চের কাছে ভেড়ার চেষ্টা করেন, যদিও আগুনের তাপের কারণে তাঁদের পক্ষে লঞ্চে উঠে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি। পরে লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া যাত্রীদের ট্রলারে করে তাঁরা নদীর তীরে নিয়ে যান। নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেন। ভেজা কাপড় পাল্টে তাঁরা যেন গরম কাপড় পরতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করেন।

দিয়াকুল গ্রামের যুবক রুবেল শরিফ দুটি শিশুকে উদ্ধার করেছেন। অভিযান-১০ লঞ্চ থেকে যখন শিশুদের চিৎকার ভেসে আসে, তখন তাঁদের বাঁচাতে এগিয়ে যান তিনি। রুবেল বলেন, ‘বড়রা যখন তাঁদের জীবন বাঁচাতে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ছিলেন, তখন দুটি শিশু লঞ্চ থেকে চিৎকার করছিল। এই দৃশ্য দেখে আমি একটি ট্রলার নিয়ে ওদের বাঁচাতে এগিয়ে যাই। আমি তাদের ট্রলারে উঠিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি শিশু আগুনের তাপে দুর্বল হয়ে নদীতে পড়ে যায়। আরও কয়েক শিশুকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে যেতে দেখলেও তাদের রক্ষা করতে পারিনি। আগুনের তাপে লঞ্চের কাছে যেতে পারছিলাম না। শুধু চোখের পানি ফেলেছি দূর থেকে।’

লঞ্চের একাধিক যাত্রীর ভাষ্য, ঝালকাঠি শহরের কাছে আসতেই লঞ্চের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ পাড়ে ভেড়ানোর চেষ্টা করেনি। পরে আগুন বেশি ছড়িয়ে পড়লে সদরের চর ভাটারকান্দা গ্রামের চরে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন লঞ্চটির চালক। কিন্তু সেখানে লঞ্চটি ভেড়াতে পারেননি। ওপারের দিয়াকুল গ্রামে গিয়ে লঞ্চটি ভেড়ে। তবে চর ভাটারকান্দা গ্রামের দুই শতাধিক যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

লঞ্চযাত্রী বরগুনার লাকুরতলার আহসান হাবিব বলেন, সেই রাতে ত্রাতার ভূমিকায় ছিলেন দিয়াকুল গ্রামের মানুষ। তাঁরা সময়মতো উদ্ধারকাজে নেমে পড়ায় অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচেছে। তাঁরা গরম কাপড়, টাকা ও খাবার দিয়ে সহায়তা করেছেন।

চর ভাটারকান্দা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী কৃষক বেলায়েত হোসেন বলেন, লঞ্চটি চর ভাটারকান্দা গ্রামের চরে আটকাতে পারলে হতাহতের সংখ্যা আরও কম হতো। চর ভটারকান্দার মানুষ দুই শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদে পাড়ে পৌঁছে দিয়েছেন।

ঝালকাঠি পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও লঞ্চঘাট এলাকার বাসিন্দা হুমায়ূন কবির চারটি ট্রলার ভাড়া করে দেড় শতাধিক যাত্রীকে উদ্ধারে তৎপরতা চালান। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আগুন, আগুন বলে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হই। দেখি, দক্ষিণ দিকের আকাশ লাল। নদীর মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলছে একটি লঞ্চ। তখন বুঝতে পারি যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন লেগেছে। দ্রুত ছোটাছুটি করে এলাকার ছোট ভাইদের ডাকি। একে একে এলাকার ২৪ জন আমার সঙ্গে বের হন। ওদের নিয়ে চারটা ট্রলার ভাড়া করে লঞ্চের দিকে যাই। তবে আগুনের তাপে লঞ্চের কাছে যেতে পারছিলাম না। কিন্তু লঞ্চ থেকে অনেক যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রলারের দিকে সাঁতরে আসেন। আমরা তাঁদের ট্রলারে তুলতে থাকি। দেড় শতাধিক যাত্রীকে নদীর তীরে নিয়ে আসি।’