সুন্দরবনের কটকা নদীর পারে চরছে দু-তিনটি বুনো শূকর ও একটি বানর। পিচ্চি বানরছানাটি দুষ্টুমিতে মেতে আছে। লম্ফঝম্ফ করে বারবার শূকরগুলোর ঘাড়ে-পিঠে বসতে চাইছে। নদীতে পূর্ণ ভাটা। শূকর ও বানর এখানে এখন পরস্পরের প্রহরী ও বন্ধু। হরিণ থাকলে আরও ভালো হতো। বিপদ এলে তা কেউ না কেউ টের পাবে।
জঙ্গলের ভেতরের কোনো গাছের মাথা থেকে ভেসে এল একটি বানরের ‘খক খক’ কাশির মতো ডাক। মুহূর্তেই নদীর পারের বানর ও শূকরগুলো স্ট্যাচু হয়ে গেল, পরমুহূর্তেই বানরের বাচ্চাটি তিন লাফে মায়ের বুকে এসে সেঁটে গেল, তারপর দাঁতালসহ বুনো শূকরগুলো মাথা ঘুরিয়ে তাকাল জঙ্গলের দিকে। কুঁতকুঁতে চোখে ওদের আতঙ্কের ছবি। দৌড়ে ওগুলো কয়েক ফুট এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল, চোখ জঙ্গলের দিকেই। কয়েক মুহূর্ত নট নড়নচড়ন। এরপর দিল ঝেড়ে দৌড়। খোলা জায়গা ধরে—নদীর সমান্তরালেই। তারপর শাঁ করে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। এদিকে বানরমাতাও বাচ্চাটিকে বুকে ঝুলিয়ে জঙ্গলমুখো হয়ে দৌড়ে গিয়ে চড়ে বসল একটি কেওড়াগাছের মাথায়। এই যে দৌড় ও পলায়ন, তা ওরা করল জঙ্গলের ভেতর থেকে আসা বানরটির ডাকের ‘ভাষা’ অনুসরণ করে। বানরটি বাঘের গতিবিধি সম্পর্কে থেমে থেমে ‘রিলে’ যেন করে যাচ্ছিল।
এ ঘটনা মুঠোফোনে গত জানুয়ারির ২৭ তারিখে আমাকে জানান মামুন। তিনি বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ ক্লাবের সদস্য। চাকরিসূত্রে গত নয় বছর সুন্দরবনে থাকছেন। মামুনের দেখা এ ঘটনা, জঙ্গল চলার পথে খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। এটা হলো বাঘের সতর্কসংকেত। বাঘ দেখে জঙ্গলের বানরটি আশপাশের সব প্রাণীকে ‘সতর্কবার্তা’ পাঠাচ্ছিল। বাঘটি সতর্কভাবেই নদীর পারের দিকে এগোচ্ছিল। কাছাকাছি থাকা বানর-শূকরেরা পালিয়ে গেছে নদীতীর থেকে।
সুন্দরবনের বানর ও হরিণের সখ্যের কথা বহুল প্রচলিত। প্রাণিজগতের এই যে অনিবার্য সখ্য তথা পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বা বিপত্সংকেত প্রদান, সেটা প্রকৃতির এক গোপন-গূঢ় রহস্যময়তায় ভরা। সুন্দরবনের বেলায় তা আরও বেশি প্রয়োজনীয়। জঙ্গলের ভাষা বন্য প্রাণীরা খুব ভালোভাবেই বোঝে। সুন্দরবনের হরিণ-শূকরসহ অন্যান্য প্রাণী যারা বাঘ-কুমির ও অজগর সাপের টার্গেট, তাদের মধ্যে সখ্য অতি জরুরি। বাঘ সুন্দরবনের মহাসম্রাট। সে কিন্তু হরিণ-শূকর-বানরের সখ্যের সুতো কেটে সুকৌশলে ঠিকই শিকার করে, খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকে। তবু সুন্দরবনে সখ্য অতি জরুরি।