বিক্রি হয়ে যাচ্ছে নওয়াব বাড়ি!
বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী ‘নওয়াব বাড়ি’ (মোহাম্মদ আলী প্যালেস) বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ওয়াক্ফ সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য না হলেও পৈতৃক সম্পত্তি দেখিয়ে নওয়াব পরিবারের কয়েকজন উত্তরসূরি কম দামে তা বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর স্মৃতিবিজড়িত এই সম্পত্তি কেনার তৎপরতা চালাচ্ছেন বগুড়ার প্রভাবশালী তিন ব্যবসায়ী। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের মধ্যস্থতায় তাঁর পরিবারের এক সদস্যসহ তিন ব্যবসায়ীর নওয়াব বাড়ি কেনার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। তবে মমতাজ উদ্দিন নওয়াব বাড়ি কেনাবেচার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
নওয়াব বাড়ি বগুড়াবাসীর কাছে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ এসে টিকিট কেটে নওয়াব প্যালেস ও প্যালেস মিউজিয়াম এবং ভেতরের বিনোদনকেন্দ্র ঘুরে দেখেন। বগুড়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন—এমন চারজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমিদারি আমলে শহরের সাতমাথা-সংলগ্ন করতোয়া নদীর ডান তীর ঘেঁষে বিশাল এলাকাজুড়ে নির্মাণ করা হয় ‘মোহাম্মদ আলী প্যালেস’। এটিই পরবর্তী সময়ে ‘নওয়াব বাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
জমিদার আবদুস সোবহান চৌধুরীর কন্যা আলতাফুন্নেছাকে বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী। আবদুস সোবহান মারা গেলে নাতি নওয়াব আলতাফ আলী জমিদারি ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতোয়ালি নিযুক্ত হন। আলতাফ আলীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ আলী মোতোয়ালি হন। মোহাম্মদ আলী চৌধুরী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৫৩ সালে।
মোহাম্মদ আলীর অবর্তমানে নওয়াব পরিবারের সদস্যরা ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেন। বিক্রি করে দেওয়া ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর গড়ে ওঠে নওয়াব বাড়ি সড়কের টিএমএসএস মহিলা মার্কেট, আল আমিন কমপ্লেক্স, শেখ শরীফ উদ্দিন সুপার মার্কেট, র্যাংগ্স ভবন ও রানার প্লাজা। এ প্লাজার জায়গা নিয়ে বর্তমানে উচ্চ আদালতে একটি মামলা বিচারাধীন। সর্বশেষ প্রায় দেড় একর জমির ওপর ‘মোহাম্মদ আলী প্যালেস মিউজিয়াম অ্যান্ড পার্ক’ রয়েছে।
বগুড়ার ইতিহাস গবেষক আবদুর রহিম বগরা অভিযোগ করেন, ‘ওয়াকফ্ সম্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও নওয়াব পরিবারের সদস্যরা বগুড়ার ঐতিহ্য মুছে ফেলতে গত রমজান মাস থেকে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন।’
মোহাম্মদ আলীর প্রথম স্ত্রী হামিদা বানুর দুই ছেলে সৈয়দ হাম্মাদ আলী চৌধুরী ও সৈয়দ হামদে আলী চৌধুরী। এঁরা বিদেশে থাকেন। হাম্মাদ আলী ও হামদে আলী গত রমজানে দেশে এসে নওয়াব বাড়ি বিক্রির জন্য দর-কষাকষি করেন। পরে দাম চূড়ান্ত হয়। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য চেষ্টা করেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
নওয়াব বাড়ি বিক্রি রুখে দিতে আন্দোলনে নেমেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বেশ কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠন। বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তৌফিক হাসান বলেন, ‘শত বছরের পুরোনো যেকোনো স্থাপনাকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করা যায়। নওয়াব প্যালেসকে প্রত্ননিদর্শন ঘোষণার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আমরা আবেদন করেছি। বিক্রির তৎপরতা ঠেকাতে আন্দোলনে নেমেছি। সাংস্কৃতিক কর্মীরা ছাড়াও সর্বস্তরের পেশাজীবীরা আমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।’
নওয়াব প্যালেসের প্রবেশ ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় বিশাল উদ্যান। হরেক ফুল আর গাছপালার ছায়াঘেরা এই প্যালেসের ভেতরে রয়েছে নানা রাইড, চিড়িয়াখানা ও মিউজিয়াম। এখানে শোভা পাচ্ছে শিল্পী আমিনুল হকের গড়া নওয়াব পরিবারের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি ও কোচোয়ান, পালকি হাঁকা বেহারা, নওয়াব পরিবারের মালিসহ পাইক-পেয়াদাদের নানা প্রতিমূর্তি। প্যালেস মিউজিয়ামের ভেতরে শিল্পী আমিনুল হক গড়ে তোলেন নওয়াবদের জলসাঘর, নায়েবদের খাজনা আদায়ের দৃশ্যসহ জমিদারি আমলের নানা কল্পদৃশ্য।
নওয়াব বাড়ির কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নওয়াব বাড়ি কেনাবেচার তৎপরতায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনও জড়িত। সম্প্রতি তাঁর মধ্যস্থতায় নওয়াব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দরদাম চূড়ান্ত হওয়ার পর বিপুল টাকা লেনদেনও হয়। মমতাজ উদ্দিনের মধ্যস্থতায় নওয়াব বাড়ি কিনছেন তাঁর এক ব্যবসায়ী পুত্রসহ শহরের প্রভাবশালী তিন ব্যবসায়ী। সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের নেতা মমতাজ উদ্দিন বলেন, ‘নওয়াব বাড়ি কেনাবেচার জন্য আমি কোনো মধ্যস্থতা করিনি। নওয়াব বাড়িতে মধ্যস্থতার জন্য গেছি—এমন প্রমাণও কেউ দিতে পারবে না।’ তবে তিনি বলেন, ‘নওয়াবদের সম্পত্তি আগেও বিক্রি হয়েছে, সেখানে বিপণিবিতানসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এখন যদি নওয়াব পরিবার তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে দেন এবং কেউ যদি তা কিনে নেন, তাতে দোষের কী?’
যোগাযোগ করা হলে নওয়াব প্যালেসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহেদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বেশ কিছুদিন দেশে ছিলাম না। হজে গিয়েছিলাম। তাই নওয়াব প্যালেস বিক্রির বিষয়টি আমার অজানা।’
বগুড়ার ব্যবসায়ী আবদুল গফুর নওয়াব বাড়ি কেনার প্রক্রিয়া চলছে বলে স্বীকার করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার একার পক্ষে এত টাকার সম্পত্তি কেনা সম্ভব নয়; সঙ্গে আরও ব্যবসায়ী রয়েছেন।’ তিনি দাবি করেন, ‘নওয়াব প্যালেস নওয়াবদের পারিবারিক সম্পত্তি। এটি ওয়াক্ফ সম্পত্তি—এমনটা কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমরা কিনব না। ওয়াক্ফ সম্পত্তি হলে আমি ব্যক্তিগতভাবেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঘোষণার পক্ষে।’
বগুড়া ওয়াক্ফ এস্টেটের পরিদর্শক মাহবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নওয়াব প্যালেস ওয়াক্ফ সম্পত্তি। আইনগতভাবে এটি হস্তান্তরযোগ্য নয়।’
তবে বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নওয়াব প্যালেস ওয়াক্ফ সম্পত্তি কি না, তা আমার জানা নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনাও এখন পর্যন্ত পাইনি।’