বাড়ির আঙিনায় উটপাখি

বাড়ির আঙিনায় খাবার খাচ্ছে উটপাখি। সম্প্রতি সিলেটের কানিশাইল গ্রামেছবি: আনিস মাহমুদ

বাড়ির সামনে বিরাট ফটক। ভেতর থেকে তালা ঝোলানো। বাইরে শিশু কোলে অপেক্ষা করছিলেন ফারুক হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তাঁদের চোখেমুখে কৌতূহল, কিছু একটা দেখার আকুতি। ফারুক হোসেন বলেন, ‘ছেলেরে নিয়া দেখতাম আইছি! ফটোত ছাড়া জীবনে কোনো দিন উটপাখি দেখছি না!’

কথা বলার মধ্যেই বাড়ির ফটক খোলা হলো। ভেতরে সবুজে ভরা আঙিনা। চারদিকে নানা ধরনের পোষা পাখি-প্রাণী। এর মধ্যে চোখ পড়ল তিনটি উটপাখির দিকে। স্বভাবসিদ্ধ গলা বাড়িয়ে মুখ উঁচুনিচু করছে। খাবার খাচ্ছে, চড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে-মধ্যে ভোঁ-দৌড়ও দিচ্ছে। এ যেন বাড়ির আঙিনা নয়, মরু অঞ্চলের কোনো তৃণভূমিতে উটপাখির বিচরণ।

বাড়িটির নাম ‘বড় বাড়ি’। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের কানিশাইল গ্রামের এই বাড়ির নতুন পরিচিতি এখন উটপাখির জন্য। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই বাড়ির আঙিনায় যাচ্ছেন নানা বয়সী মানুষ। উটপাখির সঙ্গে কেউ সেলফি তুলছেন। লাইভও করছেন কেউ কেউ।

সম্প্রতি এক বিকেলে ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় বাড়ির মালিক ছয়েফ চৌধুরীর সঙ্গে। ষাটোর্ধ্ব ছয়েফ অবসর জীবন যাপন করছেন। কাতারে একটি কোম্পানির কম্পিউটার শাখায় চাকরি করতেন। সেখানে সপরিবার বসবাস করেছেন ১৯৮৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে থিতু হন নিজ বাড়িতে। শখের বসে পশুপাখি প্রতিপালন শুরু করেন।

কাতারে থাকতেই উটপাখি পালনের বিশেষ শখ ছিল ছয়েফ চৌধুরীর। সেখানে অনেক পোষা প্রাণী পালন করেছেন। নিজেদের বাড়ি বড় হওয়ায় চারদিকে চিড়িয়াখানার মতো সীমানাপ্রাচীর দিয়ে নানা প্রজাতির কবুতর, ময়ূর, টিয়া-ময়না, ইমু পাখি পালন করছেন। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর বাড়িতে এনেছেন তিনটি উটপাখি।

টিলাশ্রেণির ভূমিতে আট বিঘা জায়গায় বাড়ি। ছয়েফ চৌধুরী ও তাঁর ছোট ভাইয়ের পরিবার বাড়িটিতে বাস করে। পাখি ও প্রাণী পালনে বাড়িতে কর্মী আছেন ১২ জন। এর মধ্যে শুধু উটপাখি দেখাশোনা করেন দুজন।

কেন এই শখ? ছয়েফ চৌধুরী জানান, দেশের বাইরে তাঁর কর্মজীবনের পুরোটা কাটলেও নিজের বাড়িতে ছেলেবেলার স্মৃতি কখনো ভুলতে পারেননি। বাড়িতে হাজারো দেশীয় গাছ তাঁর বাবার হাতে রোপণ করা। এ গাছগাছালিতে পাখি ও নানা রকম বন্য প্রাণীর আনাগোনা থাকত। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে প্রাণীর প্রতি মায়া জন্মায়। কাতারে অবস্থানকালে মনে মনে পণ করেন, চাকরি শেষে বাড়িতে ফিরবেন এবং নিজ গ্রামের মানুষকে অদেখা পাখি দেখানোর চেষ্টা করবেন।

ছয়েফ চৌধুরী খুলনার একটি খামার থেকে দুটো ইমু পাখি কিনে এনে পালন শুরু করেন। গত বছর একটি উটপাখি কিনে এনে বাড়িতে পোষেন। কিন্তু সেটি মারা যায়। এরপর প্রতিপালন বিষয়ে খামারিদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে চাঁদপুর থেকে এক বছর বয়সী তিনটি উটপাখি কিনে বাড়ির আঙিনায় প্রতিপালন করছেন।

মরু অঞ্চলের তৃণভূমির উটপাখি বাড়ির আঙিনায় প্রতিপালন কষ্টসাধ্য এক কাজ বলে মনে করেন বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উটপাখি, ময়ূর বা ইমু পাখি সাধারণত চিড়িয়াখানাতেই প্রতিপালিত হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এ রকম প্রতিপালনে কোনো আইনগত বাধা নেই।

বাবার শখকে প্রাণীপ্রেম বলে মনে করেন ছয়েফ চৌধুরীর ছেলে সাফি ছয়েফ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতি বাবার যে মায়া, সেই একই রকম মায়া পাখি ও প্রাণীর প্রতিও। আমরা বাবার এই মায়াকে সম্মান করি, শ্রদ্ধা জানাই।’