ফখরুল আগের বন্যায় হারালেন ধান, এবার গরু
মাত্র দেড় থেকে দুই মাস আগের কথা। ভাগ চাষের (বর্গা জমি) জমির বোরো ধান তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ফখরুল। তবে ঘরে তুলতে পারেননি ফসল। সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে না–উঠতেই এই দফা বন্যায় এক রাতেই মারা গেছে প্রায় দেড় লাখ টাকা দামের তিনটি গরু।
বন্যার পানিতে দাঁড়িয়ে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বাওনপুরের বাসিন্দা ফখরুল মিয়া বলছিলেন এই দুঃখের কথা। বললেন, ‘গরুর ওপরেই আমার সংসার চলে (গরু লালন–পালন করেই সংসার চলে)। কিতা করমু (কি করব)। তকদির মন্দ। বড় অসহায় অইয়া পড়লাম (হয়ে গেলাম)।’
গতকাল শনিবার বিকেলে বিশ্বনাথ সড়কে আরও অনেকের সঙ্গে জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছিলেন ফখরুল। ৫০ পেরোনো একজন মানুষ তিনি। কিছুক্ষণ পরপর জাল তুলছেন। কিছু ছোট মাছ জালে উঠছে। তা ধরে ঝোলায় রাখছেন। অনেকক্ষণ পানিতে দাঁড়ানো, বৃষ্টি ও বাতাসে ঠান্ডা লেগে কাঁপছিলেন তিনি।
ফখরুল মিয়া বললেন, গত শুক্রবার থেকে পানি বাড়ছে। এই দিনই বাড়িতে বন্যার পানি উঠে যায়। তাঁর ১৪টি গরু। চারদিকে পানি থাকায় গরুগুলো সরানোর কোনো সুযোগ পাননি। গরুগুলোও পানিতে ছিল। শুক্রবার রাতেই তিনটি গরু মারা গেছে। তাঁর ধারণা, ঠান্ডা লেগেই গরুগুলো মারা যায়। গরুর শোকে মন ভেঙে যায় ফখরুলের। মৃত গরুগুলো পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। তিনটি গরুর মূল্য আনুমানিক দেড় লাখ টাকা। এখন ১১টা গরু আছে। এগুলো নিয়েও বিপন্ন অবস্থা।
ফখরুল আরও বলেন, ‘চাইছিলাম ঈদে গরু বিক্রি করি বড় মেয়ের বিয়া দিমু (বিয়ে দিব)। কিন্তু কিচ্ছু করার নাই। তকদির মন্দ। গরু মরায় মেয়েরা কান্নাকাটি করছে। কইছি, কান্দিও না। তকদিরে যা আছে, তাই অইব।’
প্রায় ১০-১২ বছর ধরে ফখরুল গরু লালন–পালন করেন। গরু বিক্রি করে যে আয় হয়, তাই দিয়েই সংসার চালান। তিন মেয়ে তাঁর। একজন স্নাতক শ্রেণিতে, একজন উচ্চমাধ্যমিকে এবং একজন এবারের মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী।
ফখরুল বলেন, ‘এ রকম পানি আর কোনো দিন দেখছি না। ঘরও পানি উঠি গেছে। চেষ্টা করছিলাম থাকার। পারতাম নায় (পারব না)। আইজ (শনিবার রাতে) হুরুত্বারে (সন্তানদের) আত্মীয় বাড়ি পাঠাই দিমু। গরু আছে। নিজে থাকমু (থাকবো)। পেনাটেনা (কচুরিপানা), খড়-পানি গরুরে খাওয়াইমু (খাওয়াব)। টিকানির চেষ্টা করা আরকি।’
২০০৪ সালেও পানি এসেছিল বললেন ফখরুল। কিন্তু সেবার পানি ছিল বাড়ির নিচে। তাই তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি।
দেড় থেকে দুই মাস আগের বন্যায় ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন চাল কিনে খেতে হচ্ছে ফখরুল ও তাঁর পরিবারকে। পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গরু বিক্রি করে লাভের যে আশা দেখেছিলেন, এবার তাতেও ভাটা পড়ল।
ফখরুল মিয়ার প্রতিবেশী আশিক আলি বলেন, ‘ঘরর মাঝে উরাত (ঊরুসমান) পানি। ঘর ছাড়িয়া আমি আইজ (শনিবার) আশ্রয়কেন্দ্রে উঠছি। কিচ্ছু হরাইবার (সরানোর) সিস্টেম নাই। হরাইয়া নিতাম (সরিয়ে নিব) যে জাগার তো দরকার। খালি রাজাই-বেড (লেপ-তোশক) হরাইছি।’
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
সন্ধ্যা তখন ঘনিয়ে আসছে। আশিক আলী ফখরুলকে বাড়ি যাওয়ার তাগাদা দিলেন। জাল দিয়ে যে মাছ ধরছেন, তা কোথায় রান্না করবেন, সে কথাও মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না আশিক।
কিন্তু ফখরুল মিয়া একটা ঘোরের ভেতর যেন জালের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর হারানো সম্পদ হয়তো ফিরে আসবে না। এই পানিও থাকবে না। তবু তাঁকে তো এভাবেই কোনো কিছু আঁকড়ে টিকে থাকতে হবে।