সবকিছু হয়তো ছবির মতো হয় না। মায়াভরাও হয় না। তাকে সাজিয়ে তুলতে হয়। তাতে রঙের পোঁছ দিতে হয়। তারপরই তা চোখে লাগে। মুগ্ধতা, বিস্ময়ের চমকে নতুন করে ফোটে। কিন্তু কোথাও প্রকৃতি নিজেই শিল্পী, নিজেই কারিগর। ওখানে হাত দিতে হয় না। প্রকৃতি নিজের মতো করেই সাজিয়ে তুলেছে সমতলের পাশে এলানো শরীরের সবুজ পাহাড়-টিলা। হাওর-বাঁওড়, নদীতে বিস্তৃত রুপালি জলরাশির প্রাণ খুলে ঢেউয়ের নাচগান।
দেশের পূর্বাঞ্চলের জনপদ মৌলভীবাজার জেলা ও রকমই—প্রকৃতির আপন খেয়ালে অনেকটা ছবির মতোই তৈরি হয়েছে সেই দূর অতীতে। সময়ের সব দহন-রোদন বুকে নিয়ে পাহাড়-টিলা, হাওর-নদী ও সমতলের সমন্বয়ে বৈচিত্র্যে ভরা জনভূমি, জনপদ, যার আনাচকানাচে ছড়ানো টুকরা টুকরা চোখকাড়া রূপ-লাবণ্য। যেখানে বুনো ফুল ফোটে। বুনো পাখি গায়। বুনো হাওয়া ছুঁয়ে যায় নির্জনে।
মৌলভীবাজার বললে অনেকের কাছেই হয়তো একডাকে কিছু নাম কানের কাছে রিমঝিম করে বেজে ওঠে। কিছু জায়গা ছবির মতো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এর মধ্যে আছে কমলগঞ্জ উপজেলার উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। চা-বাগানের ভেতর এক টুকরা জলের হৃদয় মাধবপুর লেক। পাথারিয়া পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে আসা জলকন্যা বড়লেখা উপজেলার মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। হাইল হাওরের বুকে মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল। শ্রীমঙ্গলে চা গবেষণা কেন্দ্র (বিটিআরআই)। আর চা-বাগান তো আছেই। জেলার সাতটি উপজেলাতেই টিলায় টিলায় চায়ের বাগান। প্রগাঢ় সবুজ তরল স্রোতের মতো ঢেউ হয়ে গড়িয়ে পড়েছে ঢালুর দিকে। দেশের ৯২টি চা-বাগান এই জেলাতেই। দেশের বেশির ভাগ চা-বাগান এ জেলায় হওয়ায় জেলার ব্র্যান্ড নামও হয়েছে ‘চায়ের দেশ’। জেলার যেকোনো উপজেলার টিলাভূমিতেই পাওয়া যাবে কিছু না কিছু চা-বাগান। দেখা যাবে ছায়াবৃক্ষ ও চা-গাছের ফাঁকে ফাঁকে চা-কন্যাদের ছন্দতোলা চা-পাতা আহরণের কারুকাজ। আছে জেলার বিভিন্ন উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় আদিবাসী খাসিয়াদের গ্রাম খাসিয়াপুঞ্জিসহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতালদের বেশ কিছু পল্লি ও বৈচিত্র্যের সংস্কৃতি।
কিন্তু এই আপন সৌন্দর্যখ্যাত স্থানের বাইরেও চোখজুড়ানো, মনভোলানো স্থানের কমতি নেই, যেগুলো প্রকৃতি সব মানবিক ও প্রাকৃতিক দৈব-দুর্বিপাক থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রকৃতির শিল্পীসত্তাটি এসব স্থানে উজাড় করেছে মনের মাধুরী।
পাখিরা উষ্ণতার খোঁজে হাওয়ায় ভর করে দূর কোনো বরফভূমি থেকে উড়ে আসে যেন নিজের ঠিকানাতেই। সারা দিন মালার মতো পাখির তুলিতে ছবি আঁকা চলে হাওরের আকাশে।
এ রকম অনেক কিছুর মধ্যেই আছে কমলগঞ্জে জলকন্যা ‘হামহাম জলপ্রপাত’। কিছুটা দুর্গম পাহাড়ের বুকে শতমুদ্রার চঞ্চলতা মেলে যে গড়িয়ে পড়ছে নিচে। আছে একই উপজেলার ধলই সীমান্ত, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গৌরবের অংশ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ। আছে উপজেলার আদমপুর ও মাধবপুর এলাকাজুড়ে সমতলের আদিবাসী মণিপুরিদের জনবসতি। মণিপুরি তাঁতিদের সুতার মায়াজালে তৈরি তাঁতের শাড়ি ও চাদর বোনার তাঁত। আছে বন বিভাগের রাজকান্দি বনে পাখি ও বন্য প্রাণীর ছড়াছড়ি। হঠাৎ করে নানা পাখির সঙ্গে দু-একটা হরিণের ডাক শোনা যায় কখনো কখনো। আদমপুর বিট এলাকা, গ্রামের পাশেই টুক করে বনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার মতো এক টুকরা নির্জনতা। শমসেরনগর চা-বাগানে ক্যামেলিয়া হাসপাতাল। আছে বাগানের লেক। শমসেরনগর বিমানবন্দর।
বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড়ের উল্টোদিকেই দেশের অন্যতম জলাভূমি হাকালুকি হাওর। সারা বছরই এই হাওর রূপ খুলে থাকে। শীতে যখন হাওরের পানি কমে আসে, তখন হাওরের বুকে এখানে-সেখানে বিল-বাদাড়ে টলমল করে পানি, কোথাও গাঢ় সবুজের কোমলতা। আছে ডানা মেলা পাখির ঝাঁক। পাখিরা উষ্ণতার খোঁজে হাওয়ায় ভর করে দূর কোনো বরফভূমি থেকে উড়ে আসে যেন নিজের ঠিকানাতেই। সারা দিন মালার মতো পাখির তুলিতে ছবি আঁকা চলে হাওরের আকাশে। বিকেলে যখন সূর্য ডোবে, তার রং হাওরের বুকে তরল সোনার মতো মাখামাখি হয়ে থাকে। বর্ষায় তো অন্য চেহারা। দিগন্তখোলা জলের শাসন। খুনসুটিতে যেন বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ে একে অন্যের ওপর। হাওরের বুকে ছোটবড় নৌকা ভেসে বেড়ায়। কেউবা জলে ভাসে। কেউ হাওরপাড়েই জলভেজা ঠান্ডা বাতাসে ধুয়েমুছে ফেলে দিনের ক্লান্তি।
এই হাওরপাড়েই আছে ‘হাল্লা পাখিবাড়ি’। ব্যক্তিগত এই বাড়িটিই এখন স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখির এক নিরাপদ অভয়াশ্রম। সারা বছরই পাখির ডাক, পাখির ওড়াউড়ি গ্রামের ভেতর অন্য এক পরিবেশ তৈরি করে। পাথারিয়া পাহাড়ের ঘন সবুজ অরণ্যের বুকে জলের নূপুর বাজিয়ে থাকে চারটি ঝরনা—ঝেরঝেরি, কাখড়াছড়ি, ফুল ঢালনি ঝেরঝেরি ও ইটাউড়ি ফুলবাগিচা ঝরনা। এই নামগুলো স্থানীয় লোকজনের দেওয়া। ভারতীয় সীমান্তের ডিমাই এলাকার এই ঝরনার সঙ্গে ছোট ছোট ঝরনাও বেশ। শুষ্ক মৌসুমে কিছু ঝরনা শুকিয়ে যায়। তবে ঝিঁঝির ডাক, বুনো ফুল ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য এই স্থানটিতে বুনো বৈচিত্র্য ধরে আছে। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের কাছেই ঝরনা পরিকুণ্ড।
হাওরকন্যার মতো রাজনগরে কাউয়াদিঘি হাওরপাড়ের ‘জলের গ্রাম অন্তেহরি’ পুরাটা বর্ষাকাল জলে ভেসে থাকে। তখন বাড়িগুলো একেকটি ছোট ছোট দ্বীপ। হিজল-করসের গাছ গ্রামটিকে আগলে রাখে বারো মাস। চলে হাওরের ঢেউয়ের সঙ্গে বর্ষাজুড়ে ভিটেবাড়ির কোলাকুলি। আর কাউয়াদিঘি হাওর নিজেই তো শীত-বর্ষায় থাকে আলাদা রূপে। আছে পাঁচগাঁওয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, সংগ্রামী নারী লীলা নাগের পৈতৃক বাড়ি। লোকপুরাণের অংশ কমলারানির দিঘি।
কুলাউড়ার পৃত্থিমপাশায় ঐতিহ্যবাহী নবাব বাড়ি তো আছেই। আছে সবুজে-শ্যামলে মাখানো গগনটিলা। নির্জন বন কালাপাহাড়। মুরইছড়া ইকোপার্ক। মুরইছড়ায় আরেক ঝরনা লুতিশঙ্খ।
জেলায় ঢোকার মুখেই শ্রীমঙ্গলের শুরুর প্রান্ত সাতগাঁওয়ে আছে চা-কন্যা। সাদা পাথরের এই চা-কন্যাটিই চায়ের দেশে যে কাউকে প্রথম গ্রহণ করে। শ্রীমঙ্গল শহরে বেসরকারি উদ্যোগে বন্য প্রাণীর সেবা ও সংরক্ষণের জন্য গড়ে ওঠা বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন অনেক বিরল, বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর আশ্রয়কেন্দ্র। এখানে বন্য প্রাণীদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ আছে। আছে ভারতের উৎস থেকে আসা নাহারপুঞ্জির কাছে পাহাড়ি ছড়ার সরু গিরিখাত, যার আদিবাসী খাসি ভাষার নাম ক্রেম ক্লু (ক্লুর খাত)।
মৌলভীবাজার শহরের কাছেই একপশলা নির্জন বনভূমি বর্ষিজুড়া ইকোপার্ক। শহর থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে গাছপালার নিবিড় ভালো লাগা তৈরি করেছে বনভূমিটি। আছে শহরতলির মাতারকাপনে মনু ব্যারেজ। ইচ্ছা হলেই ছুটে যাওয়ার মতো দুপাশে গ্রাম রেখে নদীর স্রোতের সঙ্গে দেখা, ঢেউয়ের সঙ্গে দেখা।
যে জনপদের শিল্পী প্রকৃতি নিজেই। সেখানে যেদিকেই চোখ পড়ে, সেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শিল্পীর মমত্বের ছোঁয়া।