নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের জন্য এক তরুণীকে হেনস্তার প্রতিবাদ জানাতে নিজেদের ‘পছন্দমতো পোশাক’ পরে স্টেশনটিতে গিয়েছেন ২০ জন নারী-পুরুষ। আজ শুক্রবার সকাল সড়ে আটটার দিকে ঢাকা থেকে নরসিংদীগামী একটি ট্রেনে করে স্টেশনটিতে যান তাঁরা।
এ যাত্রার নাম তাঁরা দিয়েছেন ‘অহিংস অগ্নিযাত্রা’। অগ্নি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে তাঁরা যুক্ত। তাঁদের ভাষ্য, ১৮ মে ঢাকা থেকে নরসিংদীতে বেড়াতে যাওয়া এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী রেলস্টেশনে যে আক্রমণ ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এখানে এসেছেন তাঁরা। এটিকে তাঁরা প্রতিবাদ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের এ দলে শিল্পী, সংগঠক, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, আলোকচিত্রী, গবেষক, উন্নয়নকর্মী ও প্রকৌশলীরা আছেন।
দলটির দলনেতা ও অগ্নি ফাউন্ডেশনের সভাপতি তৃষিয়া নাশতারান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ আমরা নরসিংদী রেলস্টেশন ও এখানকার মানুষদের দেখতে এসেছি। তাঁদের সঙ্গে আমরা মানবিক যোগাযোগ স্থাপন করতে চেয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, শান্তিপূর্ণভাবে জনপরিসরে শরীর ও পোশাকের স্বাধীনতার জায়গাটা রিক্লেইম করা। আমাদের বৈচিত্র্যময় শারীরিক উপস্থিতিই আমাদের বক্তব্য।’
নরসিংদী রেলস্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ট্রেন থেকে নামার পরপরই এই দলটি নানা বয়সী অপেক্ষমাণ যাত্রী ও ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের সঙ্গে ১৮ মের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন। পরে তাঁরা কয়েকটি উপদলে ভাগ হয়ে স্টেশনের নানা প্রান্তে ঘোরেন। এরপর স্টেশনমাস্টার এ টি এম মুছার সঙ্গে বৈঠক করেন তাঁরা। এর আগে রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গেও ওই দিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন দলটির সদস্যরা।
নরসিংদী রেলস্টেশনের মাস্টার এ টি এম মুছা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলটি ঢাকা থেকে ট্রেনে করে আমাদের স্টেশনে এসে নেমেছে। তারা স্টেশন ঘুরে দেখেছে এবং এখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছে। আমার সঙ্গে তারা বসেছিল, জানতে চেয়েছে ওই দিনের বিস্তারিত। আমিও তাদের ওই ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়েছি। তারা তরুণী হেনস্তার প্রতিবাদ জানাতে এসেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।’
১৮ মে নরসিংদী রেলস্টেশনে হেনস্তার শিকার হন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। দুই বন্ধুর সঙ্গে সকাল পৌনে ছয়টার দিকে ঢাকাগামী ঢাকা মেইল ট্রেনের অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এ সময় স্টেশনে মধ্যবয়সী এক নারী ওই তরুণীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এটা কী পোশাক পরেছ তুমি?’ তরুণীও পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনার তাতে কী সমস্যা হচ্ছে?’ এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। এর মধ্যে সেই বিতর্কে যোগ দেন স্টেশনে অবস্থানরত অন্য কয়েকজন ব্যক্তি।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, ওই তরুণীকে ঘিরে রেখেছে একদল ব্যক্তি। এর মধ্যেই এক নারী উত্তেজিত অবস্থায় তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। বয়স্ক এক ব্যক্তিও তাঁর পোশাক নিয়ে কথা বলছেন। একপর্যায়ে ওই তরুণী সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে ওই নারী দৌড়ে তাঁকে ধরে ফেলেন। এ সময় অশ্লীল গালিগালাজ করতে করতে তাঁর পোশাক ধরে টান দেন ওই নারী। কোনো রকমে নিজেকে সামলে দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে চলে যান তরুণী।
ওই ঘটনার সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ২১ মে রাত নয়টার দিকে নরসিংদী রেলস্টেশনসংলগ্ন এলাকা থেকে ঘটনায় জড়িত মো. ইসমাইল নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাঁকে ভৈরব রেলওয়ে থানা-পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরদিন শনিবার বিকেলে তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে নরসিংদীর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ সিদ্দিকীর আদালতে তোলা হয়। আদালত তাঁকে জেলহাজতে পাঠান এবং এ ঘটনায় মামলা করার নির্দেশ দেন।
ওই রাতেই ভৈরব রেলওয়ে থানায় মামলা করেন নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইমায়েদুল জাহেদী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ও ৩০ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৩ ও ৫০৬ ধারায় মামলাটি করা হয়। মামলায় মো. ইসমাইল ও শিলা আক্তারের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও একজন নারী ও ৮ থেকে ১০ জন পুরুষকে আসামি করা হয়। গত সোমবার ইসমাইলকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হলে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তবে তরুণীকে গালিগালাজ, মারধর, শ্লীলতাহানি ও মুঠোফোনে ছবি তোলার অভিযোগে মামলার আসামি ওই নারীকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি।