ক্যানসারে আক্রান্ত রোজিনা বেগম। তিন দিন আগে বহু কষ্ট করে চিকিৎসার জন্য নরসিংদী থেকে রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে এসেছিলেন। চিকিৎসা শেষে লকডাউনের মধ্যে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পলাশকুলী এলাকায় যেতে আবারও ভোগান্তিতে পড়েছেন। গণপরিবহন বন্ধ। রিকশা, সিএনজি অটোরিকশায় ভেঙে ভেঙেই পুরো পথটা যেতে হবে তাঁকে।
করোনার সংক্রমণ ছড়াতে পারে, এ শঙ্কায় গত ৫ এপ্রিল থেকে সারা দেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাতে বাস, ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে রিকশা-অটোরিকশাগুলো মহাসড়কে নেমে এসেছে। তিন চাকার এসব যান, ট্রাক-পিকআপ, মাইক্রোবাসে মানুষ গাদাগাদি করে দূর গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছে। এই যানবাহনগুলোতে সামাজিক দুরত্ব রক্ষার কোন সুযোগই নেই।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ক্যান্সার রোগী রোজিনা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গাদাগাদি করে যাত্রী নিয়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে ছুটছে তিন চাকার যানগুলো। রোজিনা এ রকম একটি অটোরিকশার যাত্রী হলেন। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী সুতার ছোট ব্যবসায়ী। তাঁর ব্রেস্ট ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য নিয়মিত বিএসএমএমইউতে আসতে হয়। সকালে বিএসএমএমইউ থেকে চিকিৎসা শেষে রিকশায় গুলিস্তান আসেন এবং সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশায় সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ড থেকে যে সিএনজিতে উঠেছেন, সেটি ভুলতা-গাউছিয়া পর্যন্ত যাবে। এরপর সেখান থেকে আবার সিএনজি বদলে নরসিংদীর পথ ধরবেন তিনি। রোদ–গরমের মধ্যে যাতায়াতের ধকলে কাহিল হয়ে পড়েছেন অসুস্থ রোজিনা। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, যাত্রীবাহী বাস ছাড়া আর অন্য সব গাড়ি চলছে। তিন চাকার যানগুলো সুযোগ পেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঘুরে দেখা গেছে তিন চাকার যানের দাপট। সাইনবোর্ড, শিমরাইল, কাঁচপুর পয়েন্টে সিএনজি অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো যাত্রী ওঠানো–নামানো করছে, চলছে ডাকাডাকি। এ ছাড়া মাইক্রোবাস, কার, মোটরসাইকেল এমনকি অ্যাম্বুলেন্সেও ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছেন চালকেরা। আর কিছু না পেয়ে দূরের গন্তব্যে যেতে অনেকে খোলা পিকআপভ্যানেও চেপে বসছেন। ট্রাফিক পুলিশের একটি রেকার বসে থাকতে দেখা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে লোকজন অবাধে গাদাগাদি করে যাতায়াত করলেও পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই।
দুই ছেলেসহ কুমিল্লার জেলার দেবিদ্বারে গ্রামের বাড়িতে যাবেন আমেনা বেগম। সঙ্গে বড় একটি ব্যাগও রয়েছে। তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনে তাঁদেরকে গ্রামের বাড়িতে যেতে হচ্ছে। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে জনপ্রতি ৬০০ টাকায় ভাড়ায় মাইক্রোবাসে উঠছেন।
সাইনবোর্ড থেকে মদনপুর বা ভুলতা যেতে সিএনজি অটোরিকশাগুলো যাত্রীপ্রতি ৮০ টাকা করে নিচ্ছে। এখান থেকে দাউদকান্দি যেতে নেওয়া হচ্ছে ২৫০ টাকা। অথচ অন্য সময়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় সাইনবোর্ড থেকে ভুলতা-গাউছিয়া ৬০ টাকা ভাড়া। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় সাইনবোর্ড থেকে কাঁচপুর ৬০ টাকা ভাড়াও নেওয়া হচ্ছে।
ঝুঁকি নিয়ে মিনিট্রাকে করে যাত্রাবাড়ী থেকে মোগড়াপাড়া যাচ্ছেন কামাল হোসেন। তিনি বলেন, জনপ্রতি ৬০ টাকায় ভাড়ায় ১৫–২০ মিলে খোলা মিনি ট্রাকে তাঁরা মোগরাপাড়া যাচ্ছেন। সেখান থেকে যে যার গন্তব্য অনুযায়ী অন্য বাহনে উঠবেন। কথা হলো সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, কুমিল্লার দাউদকান্দি যাবেন। কিন্তু বাস চলাচল বন্ধ। তাই অটোরিকশা ছয়জন মিলে মোগড়াপাড়া যাবেন। সেখান থেকে আবার অন্য কোনো যানবাহনে দাউদকান্দি যাবেন।
যাত্রীবাহী বাস ছাড়া আর অন্য সব গাড়ি চলছে। তিন চাকার যানগুলো সুযোগ পেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।রোজিনা বেগম, ভূক্তভোগী যাত্রী
চালকেরা বলছেন, ভাড়া বেশি পেলেও পুলিশের মামলার ভয় আছে। কয়েকজন জানালেন রাস্তায় চাঁদাবাজি ও ঘুষ আদায়ের অভিযোগও। সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক জহিরুল ইসলাম জানান, পুলিশ আটক করে মামলা ও রেকার বিল নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, সাইনবোর্ড থেকে কাঁচপুর জনপ্রতি ২০ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছেন। ছয়জন করে যাত্রী বহন করছেন তাঁরা। তিনি বলেন, এমনিতে তাঁরা মহাসড়কে আসতে পারেন না। লকডাউনে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের চাপ বেড়েছে মহাসড়কে। তাই তাঁরাও অন্য রুট থেকে এখানে এসে যাত্রী পরিবহন করছেন।
কথা হলো সাইনবোর্ডে এলাকায় দায়িত্বরত নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের উপপরিদর্শক (টিএসআই) কুশল কুমার সাহার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গণপরিবহন সব বন্ধ ঘোষণা থাকলেও শুধু বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। অন্য পরিবহনগুলো সরকারি নির্দেশনা মানছেন না। তিনি বলেন, তাদের এখানে পাঁচজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। কিন্তু তাঁদের পক্ষে এত গাড়ি আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও তাঁরা অবৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আটক করছেন মামলা দিচ্ছেন। তবু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও রিকশা
গত বুধবার সকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর এলাকায় অনেক মানুষের সমাগম দেখা যায়। তাঁরা প্রায় সবাই অপেক্ষা করছেন যানবাহনের জন্য। এর মধ্যে কোনো একটি রিকশা-অটোরিকশা এলেই হুড়োহুড়ি পড়ে যাচ্ছে। এরপর ছোট যানগুলোতে গাদাগাদি করে ভ্রমণ করছেন মানুষ। টঙ্গীর স্টেশন রোড, জোড়পুকুর, জয়দেবপুর লেভেল ক্রসিং, শিববাড়ি মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়েও ব্যাটারিচালিত রিকশা বা অটোরিকশায় গাদাগাদি করে যাত্রীদের চলাচল করতে দেখা গেছে।
বুধবার সকাল নয়টায় রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায় স্থানীয় আউচপাড়া এলাকার মো. হাসেম মিয়াকে। তাঁর টঙ্গী বাজারে স্বর্ণালংকারের ব্যবসা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সেই সকাল থেকে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে কোনো রিকশা এলে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠছে। বাস না চলায় সবার এ ভোগান্তি। বাধ্য হয়েই করোনার ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।’
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে চান্দনা চৌরাস্তা, টঙ্গী-ঘোড়াশাল আঞ্চলিক সড়কের টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে মিরের বাজার, নগরের শিববাড়ি মোড়, জোড়পুকুর, নতুন বাজার, কলেজগেট, হোসেন মার্কেটসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রিকশাই বেশি চলতে দেখা গেল। ওই সব ছোট যানবাহনে সামাজিক দূরত্ব মানার কোনো বালাই নেই।
এসব যান চলাচলের বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘পুলিশের তৎপরতা আগের মতোই আছে। বিভিন্ন দোকানপাট বা পোশাক কারখানা খোলা থাকায় মানুষের চলাচল বেড়েছে। কিন্তু একাধিক যাত্রী পরিবহন বা স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়টি আমাদের চোখের সামনে পড়ামাত্রই আমরা তাঁদের সতর্ক করছি। সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে আমাদের চেকপোস্ট রয়েছে।’