তরুণ উদ্যোক্তাদের গরুর খামার
রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে পাস করে যুক্তরাজ্য থেকে সিএ শেষ করেছেন ফয়সাল বিন মালেক। তাঁর বন্ধু সাব্বির আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে দেশে ফিরেছেন। দুই বন্ধু আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে বছর পাঁচেক আগে শিক্ষাবিষয়ক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ২০১৭ সালের দিকে চার বন্ধু মিলে একটি গরুর খামার করেন। দুটি গরু দিয়ে শুরু। তিন বছরেই খামারে এখন ১০০টি গরু। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের রাজেন্দ্রপুরে ফয়সালের নানাবাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে খামারটি। গত কোরবানির ঈদে এ খামার থেকে ৩৫টি গরু বিক্রি হয়েছে।
ফয়সাল ও তাঁর বন্ধুরা দুই বিঘা জমি কিনে খামারটি শুরু করেছিলেন। এখন সে খামারটি ৫০ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে। এই চার বন্ধু শুধু নন, এখন অনেকেই গবাদিপশুর খামার করছেন। প্রতিবছর দেশে ৭০ হাজার করে নতুন গবাদিপশুর খামার যুক্ত হচ্ছে। মূলত, কোরবানির হাট ও দুধ বিক্রির লক্ষ্য নিয়ে শুরু হওয়া এসব খামারের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা হচ্ছেন তরুণ। এসব তরুণ এ বছর কোরবানির হাটে যে পরিমাণ গরু–ছাগলের জোগান দিয়েছেন, তাতে বিদেশ থেকে আর আমদানির দরকার হয়নি। উল্টো দেশের গরু দিয়ে চাহিদা মিটিয়ে এ বছর ১০ থেকে ১২ লাখ গরু উদ্বৃত্ত হয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফয়সাল বিন মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজেদের পারিবারিক জমি ও পুঁজি আর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে খামারটি শুরু করেছি। এখনো লাভের মুখ দেখিনি। তবে এই কাজ করে আনন্দ পাচ্ছি। আশা করি, দু–তিন বছরের মধ্যে লাভ দেখতে পাব।
খামারের গোবর থেকে বায়োগ্যাস দিয়ে আশপাশের ২৫টি পরিবারের গ্যাসের চুলা জ্বলে, তা দেখতেও ভালো লাগে।’
উচ্চশিক্ষিত এসব তরুণের গরুর খামার কেউ যদি দেখতে চান, তাহলে খুব বেশি দূর যেতে হবে না। রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকাতেই প্রায় পাঁচ হাজার নতুন ও আধুনিক খামার গড়ে উঠেছে। গত তিন–চার বছরে গড়ে ওঠা এসব খামারে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। এসব যন্ত্র ও প্রযুক্তি দিয়ে খামারের বাইরের ও ভেতরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, বসিলা, কেরানীগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া থেকে শুরু করে গাজীপুর হয়ে ময়মনসিংহ পর্যন্ত এসব খামার বিস্তৃত হচ্ছে। বেঙ্গল মিট, দেশি মিটের মতো বড় প্রতিষ্ঠান গবাদিপশুর লালন–পালনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
এসব উদ্যোক্তাদের কমপক্ষে ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে এসব উন্নত খামার থেকে প্রায় সাত হাজার গরু বিক্রি হয়েছে। হাটে আসা গরুর মধ্যে ১০ থেকে ১২ লাখ গরু এবার অবিক্রীত ছিল। কিন্তু অনলাইনের মাধ্যমে এবার যাঁরা বিক্রিতে নেমেছিলেন, তাঁদের কোনো পশু এবার অবিক্রীত নেই। আসছে বছর এই উদ্যোক্তারা গরু–ছাগল লালন–পালনের পরিমাণ আরও বাড়াবেন।
উদ্যোক্তাদের ৭০% তরুণ
সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে, দেশে প্রতিবছর গবাদিপশুর খামারির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০১৩ সালে ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর দেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা গবাদিপশু লালন-পালনে ঝুঁকে পড়েন। এসব উদ্যোক্তার প্রায় ৭০ শতাংশই তরুণ। তাঁদের বড় অংশ শিক্ষিত পেশাজীবী। তাঁরা মূল পেশার পাশাপাশি এসব খামার গড়ে তুলছেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৭ সালে দেশে মোট খামারি ছিলেন ৩ লাখ ৭৭ হাজার। চলতি বছর তা বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৪১৬। এই হিসাবে প্রতিবছর প্রায় ৭০ হাজার খামারি গরু-ছাগলের জোগানে যুক্ত হচ্ছেন। মোট খামারের মাত্র ৫৭ হাজার সরকারিভাবে নিবন্ধিত। নিবন্ধিত এসব খামারে ১০টির বেশি গরু রয়েছে। বাকি ৫ লাখ ২০ হাজার খামারির গরু আছে ৩ থেকে ১০টি। তাঁরা মূলত কোরবানির বাজার ধরার জন্য খামার গড়ে তুলেছেন। সেই হিসাবে দেশে ১০–১১ লাখ তরুণ গবাদিপশুর খামারের সঙ্গে যুক্ত।
এবারের কোরবানির পশুর হাট ও দেশের গবাদিপশু উৎপাদন সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ধান-পাট বা গমচাষিরা যেমন ভর্তুকিসহ সরকারি বিভিন্ন সুবিধা পান, গরুর খামারিরা তেমন কিছু পান না। বরং উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে খামার গড়ে তুলতে হচ্ছে। ফলে গরুর উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে। ভোক্তাদের জন্য আরও কম দামে গরু ও মাংসের জোগান দিতে হলে এই খাতে সরকারের সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
একাধিক গবাদিপশুর খামারি ও অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তরুণ এসব খামারির মূল পুঁজি এসেছে মূলত নিজস্ব উদ্যোগ ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে। এ ছাড়া প্রবাসী আয়, ব্যাংক ও বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ঋণ এবং ব্যক্তিগত সঞ্চয়কে পুঁজি করে এসব খামার গড়ে উঠেছে।
ছাগল লালন–পালনে এগিয়ে নারীরা
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র উদ্যোগে সবচেয়ে বড় অর্থায়নকারী সরকারি সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। সংস্থাটির হিসাবে গবাদিপশু খাতের বিনিয়োগ থেকে আসা মুনাফার ৮০ শতাংশ গ্রামেই থাকছে ও পুনর্বিনিয়োগ হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের দুগ্ধ ও চামড়াশিল্প, কৃষি খাতে সার হিসেবে গোবরের ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষ করে ছাগল লালন-পালনের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থ গ্রামীণ নারীদের হাতে থাকছে। এখান থেকে আসা অর্থের বড় অংশ পারিবারিক পুষ্টি ও শিক্ষার ব্যয় মেটানোয় কাজে লাগে।
এ ব্যাপারে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, ‘দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে। দেশের কৃষির যে কটি উপখাত রয়েছে, তার মধ্যে গবাদিপশু লালন-পালনে উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি লাভের মুখ দেখছেন। এসব খামারির ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রাণী সুরক্ষা বিমার প্রচলন শুরু করেছি।’
পিকেএসএফের হিসাবে, দেশে ক্ষুদ্রঋণের এখন ৪০ শতাংশ নিচ্ছে গবাদিপশুর খামারিরা। সংস্থাটির নিজস্ব অর্থায়ন, সহযোগী সংস্থাগুলোর বিনিয়োগ এবং উদ্যোক্তাদের পুঁজি মিলিয়ে এই খাতে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যাংকের মাধ্যমে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।