শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়
১৪ ছাত্রের চুল কেটে দেওয়ার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ৪ শিক্ষার্থী–কর্মচারীর ভাষ্য
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এ সময় ঘটনাস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের কম্পিউটার শাখা থেকে ঘটনা সংশ্লিষ্ট ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুই শিক্ষার্থী ও দুই কর্মচারীর বয়ানে ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা মেলে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের দুই কর্মচারী অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সজিব সরকার ও অফিস সহায়ক আবদুল মালেক। আর দুই শিক্ষার্থী হলেন একই বিভাগের তামান্না আক্তার ও শান্তনা রানী।
কর্মচারী সজিব সরকার বলেন, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন আমাকে দিয়ে কাঁচি আনিয়ে একে একে ১৩ থেকে ১৪ ছাত্রের চুল হাত দিয়ে টেনে ধরে কেটে দেন। সে সময় শিক্ষার্থীরা ছাড়াও কয়েকজন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তবে তাঁরা কেউ এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি।’
আরেক কর্মচারী আবদুল মালেক বলেন, ‘আমিও ঘটনার সময় কাজের সহায়তার জন্য পরীক্ষার হলে অবস্থান করছিলাম। সেখানে আমি শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিনকে ছাত্রদের চুল টেনে ধরে কাঁচি দিয়ে কাটতে দেখেছি।’
এ ছাড়া সিসি ক্যামেরার ফুটেজে শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিনকে কাঁচি হাতে দেখা গেছে। পরীক্ষার হলের বারান্দার মেঝেতে কাটা চুল পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার ও শান্তনা রানী বলেন, শিক্ষক ফারহানার উগ্র আচরণের কারণে পরীক্ষার হলে অবস্থানরত অন্য শিক্ষকেরাও কিছু বলতে সাহস করেননি।
এই ১৪ শিক্ষার্থী হলেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের নাজমুল হাসান তুহিন, তানভীর হোসেন, নোমান সিদ্দিকী শান্ত, সিরাত, হাবীবুর রহমান, নূর আল-হাবীব, সাকিল আহম্মেদ নিলয়, আল আমিন, তাইবুর রহমান, আমিনুল ইসলাম নাঈম, মাজেদুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, নাঈম ইসলাম ও জাহিদুর রহমান হিমেল। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, ফারহানা তাদের চুল কেটে দিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দেওয়া প্রসঙ্গে তানভীর হাসান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, দীর্ঘদিন পর পরীক্ষা শুরু হলেও শিক্ষক ফারহানা পরীক্ষার তিন-চার দিন আগে নিয়মবহির্ভূতভাবে রুটিন দিয়েছেন। রুটিনে প্রতিদিনই পরীক্ষা রয়েছে। এটি যৌক্তিক না হওয়ায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে ওই শিক্ষক স্মারকলিপি দিতে আসা শিক্ষার্থীদের নাম সংগ্রহ করেন। যাঁরা স্মারকলিপি দিতে চেয়েছিলেন, ঠিক তাঁদেরই চুল কাটা হয়েছে।
সুজন নামে দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রের ভাষ্য, ক্লাসের মধ্যে ওই শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ করেন। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তিনি নানা রকম কথা বলেন। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সোহাগ ও ফারাহ নাজ নিঝুমের ভাষ্য, ওই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্মপরিচয় তুলেও গালি দেন। তাঁর কোনো কথার প্রতিবাদ করলে তিনি পরীক্ষায় ফেল করানোর ভয় দেখান।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক রিফাত রহমানের দাবি, ‘ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড মেনে চলার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। তবে খারাপ আচরণের বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরা কখনো কোনো অভিযোগ দেয়নি। আমাদের নজরে পড়লেও সেটাকে গুরুত্ব দিইনি। আমরা ভেবেছি, হয়তো তিনি শিক্ষার্থীর সঙ্গে আড়ালে ভালো আচরণ করেন।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ফারহানা ইয়াসমিন চুল কাটার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, ‘আমার একটু রাগ আছে। পরীক্ষার জন্য, পড়ালেখার জন্য আমি শিক্ষার্থীদের একটু একটু বকাঝকা করি। কিছু ছাত্র আমার কাছে এসে পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে বলেছিল। আমি এতে রাজি হইনি। হয়তো সেই রাগে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান, সহকারী প্রক্টর ও সিন্ডিকেট সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। চুল কেটে দেওয়ার ঘটনাটি তদন্তে রবীন্দ্র অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান লায়লা ফেরদৌস হিমেলকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান লায়লা ফেরদৌস হিমেল বলেন, ‘চুল কেটে দেওয়া ছাড়াও শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করা এবং তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণের একাধিক অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তাঁর বিরুদ্ধে শুধু একটি বিভাগের অভিযোগ নয়, সব বিভাগেরই অভিযোগ আছে। জুতার শব্দ হলেও তিনি শিক্ষার্থীদের শাসন করেন বলে অভিযোগ এসেছে। সব অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিষয়গুলো জানা যাবে।’