কোরআন অবমাননার কথা স্বীকার, ঘটনার নেপথ্যে কে বলছেন না ইকবাল
পুলিশ বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল হোসেন একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছেন। কোনো প্রশ্নেরই সদুত্তর দিচ্ছেন না।
পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনার সাত দিন পর পুলিশ জানায়, যে ব্যক্তি কাজটি করেছেন, তাঁকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। নাম ইকবাল হোসেন। তিনি কুমিল্লা শহরেরই বাসিন্দা, তবে ‘ভবঘুরে ও মাদকাসক্ত’। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলছে, জিজ্ঞাসাবাদেও কোরআন অবমাননার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ইকবাল। তবে কেন এই কাজ তিনি করতে গেলেন, তাঁকে দিয়ে এ কাজ কারা করিয়েছেন, ঘটনার নেপথ্যের ব্যক্তিরা কারা—এসব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
পুলিশ সূত্র বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছেন। কোনো প্রশ্নেরই সদুত্তর দিচ্ছেন না।
ইকবালকে গতকাল শুক্রবার দুপুরে কক্সবাজার থেকে কুমিল্লা পুলিশ লাইনসে আনা হয়। সেখানে তাঁকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখা এবং প্রতিমা থেকে গদা সরানোর বিষয়টি স্বীকার করেছেন ইকবাল।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ইকবালের কাছে কয়েকটি বিষয়ে জানতে চেয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে কিছু বিষয় তিনি স্বীকার করেছেন। কিছু প্রশ্নের জবাব পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ইকবালের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ যাঁদের ঘনিষ্ঠতা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে, তাঁদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার শুরুটা কুমিল্লা শহরের নানুয়া দীঘির উত্তর পাড়ে দুর্গাপূজা উপলক্ষে অস্থায়ীভাবে করা একটি পূজামণ্ডপ থেকে। ১৩ অক্টোবর সকালে এই পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমে কুমিল্লা শহরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয় এবং চারটি মন্দির ও সাতটি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঘটনার জের ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালীর চৌমুহনী, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, ফেনী, রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মন্দির-মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুরের পাশাপাশি আক্রমণের শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। পীরগঞ্জে পুড়িয়ে দেওয়া হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়ি।
ইকবালের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে কুমিল্লা মহানগর পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁকে (ইকবাল) দিয়ে যাঁরা এই কাজ করিয়েছেন, তাঁদের চেহারা দেখতে চাই। আসল ঘটনার নায়ককে দেখতে চাই। ইকবালকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তদন্তের অগ্রগতি হয়েছে সত্য, তবে মূল পরিকল্পনাকারী কারা, তা তো এখনো জানা গেল না। আমরা প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তি দাবি করছি।’
কুমিল্লার ঘটনায় আটটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে জামায়াতের তিন কাউন্সিলর, বিএনপির কয়েকজন কর্মীসহ ৯১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৭০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ এ পর্যন্ত ৪৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
যেভাবে ধরা পড়লেন
পুলিশ সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল বলেছেন, ১৩ অক্টোবর দুপুরে ট্রেনে করে কুমিল্লা থেকে তিনি প্রথমে চট্টগ্রামে পৌঁছান। এরপর তিনি কক্সবাজার যান। জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল কখনো বলেছেন, চট্টগ্রাম থেকে হেঁটে কক্সবাজারে গিয়েছেন। কখনো বলেছেন, হেঁটে নয়, বাসে করে গেছেন। কক্সবাজারে যাওয়া নিয়ে তিনি অসংলগ্ন কথা বলছেন।
কক্সবাজারে ইকবাল কোথায় ছিলেন, কত টাকা নিয়ে সেখানে গেছেন, মুঠোফোন কেন সঙ্গে ছিল না—এসব বিষয়ে তিনি কী তথ্য দিয়েছেন, তা পুলিশ এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত বুধবার নোয়াখালীর চৌমুহনী এস এ কলেজের তিন শিক্ষার্থী কক্সবাজারে বেড়াতে যান। ওই দিন কলাতলী সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর সময় এক ব্যক্তির দিকে চোখ যায় তাঁদের। যাকে দেখতে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছিল। তবে বিষয়টি বেশিক্ষণ পাত্তা দেননি তাঁরা। সমুদ্রে নেমে পড়েন তিনজন। ওই ব্যক্তির কথা ভুলে যান।
পরদিন বৃহস্পতিবার আবার ওই ব্যক্তির সামনে পড়েন। এবার সুগন্ধা সমুদ্রসৈকতে। লোকটির অদ্ভুত আচরণ, ঘোরাঘুরি অনেকের মতো তিন বন্ধুর কাছেও ধরা পড়ে। একপর্যায়ে তিনজনের একজন সাজেদুর রহমানের কাছে লোকটিকে চেনা চেনা মনে হয়। রহস্যভেদের চেষ্টা পেয়ে বসে তাঁদের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই ব্যক্তির ছবি দেখেছেন বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। এরপর মুঠোফোনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবির সঙ্গে ওই ব্যক্তির ছবি মেলাতে শুরু করেন তাঁরা।
সাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে আসা ব্যক্তিটিই (ইকবাল হোসেন) এই ব্যক্তি। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। এরপর নোয়াখালীর সহকারী পুলিশ সুপারের নম্বরে ফোন করে বিষয়টি জানাই।’
পুলিশ সূত্র জানায়, পরে বিষয়টি নোয়াখালীর পুলিশ সুপার কুমিল্লার পুলিশ সুপারকে জানান।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার আমাকে জানান, সমুদ্রসৈকত থেকে তাঁকে ফোন করে বলা হয়েছে, ইকবালের মতো একজনকে দেখা যাচ্ছে। যাঁরা ফোন করেছিলেন, তাঁদের আমরা পুলিশ ঘটনাস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত নজরদারিতে রাখতে বলি।’ পরে কক্সবাজার জেলার পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ইকবালকে আটক করে।
ফারুক আহমেদ বলেন, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছবি পুলিশ ইকবালের পরিবারের সদস্যদের দেখায়। তারপরই তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান এই সেই ইকবাল, যাঁকে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা খুঁজছেন।
পরে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সোহান সরকারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল কক্সবাজার থেকে গতকাল ইকবালকে কুমিল্লায় নিয়ে আসে।
কাজীবাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরায় ইকবালকে শনাক্তের প্রথম ধাপ
নানুয়া দীঘির পাড় এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পুলিশ সংগ্রহ করে ১৪ অক্টোবর। এর মধ্যে নানুয়া দিঘির পশ্চিম উত্তর কোনার কাজীবাড়ি থেকে নেওয়া ১২ অক্টোবর গভীর রাতের একটি ফুটেজে দেখা যায়, এক ব্যক্তি গদা হাতে নিয়ে ঘুরছেন। এই ক্লু নিয়েই প্রথম তদন্তকারী দল মাঠে নামে। এরপর আরও কয়েকটি ফুটেজ দেখে ইকবালকে শনাক্ত করা হয়। তদন্তের একপর্যায়ে পুলিশ ইকবালের বাবা নুর আহমেদ আলম, মামা তাজুল ইসলাম ও ছোট ভাই সাফায়েত হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। তাঁদের বক্তব্য ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনায় ইকবালের জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয় পুলিশ।
কাজীবাড়ির বাসিন্দা ব্যাংকার কাজী ফখরুল ইসলাম বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল, শারদীয় দুর্গাপূজায় প্রতিটি পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ২৪ ঘণ্টা পাহারা থাকতে হবে। কিন্তু নানুয়া দিঘির পূজামণ্ডপে সেটি ছিল না। কিন্তু এখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই একসঙ্গে থাকে। এই ঘটনায় সবাই হতভম্ব।
তদন্তের মেয়াদ বেড়েছে
ঘটনার পর কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. সায়েদুল আরেফিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও কমিটি প্রতিবেদন দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘তদন্ত কমিটির মেয়াদ ১৫ কর্মদিবস বাড়ানো হয়েছে। আর এখন তো ইকবালই ধরা পড়েছেন। তাঁর কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাবে। তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছি আমরা।’
কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলায় আহত এক ব্যক্তির মৃত্যু
১৩ অক্টোবর নানুয়া দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ কিছু লোক মনোহরপুর এলাকায় মিছিল বের করেন। মিছিলটি রাজরাজেশ্বরী কালীবাড়ি মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। তখন মন্দিরের প্রধান ফটক বন্ধ করতে যান দিলীপ কুমার দাস। মিছিল থেকে ইটের টুকরো তাঁর কপাল ও মাথায় পড়ে। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিত্সার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ৯ দিন চিকিত্সাধীন থাকার পর গত বৃহস্পতিবার রাতে তিনি মারা যান।
দিলীপের বাসা কুমিল্লার কোতোয়ালি থানা ফটকের উল্টো দিকে পানপট্টি এলাকায়। তিনি ওই এলাকার বাসিন্দা বিষুলাল দাসের ছেলে। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন দিলীপ।
নিহত দিলীপের ভাতিজা শান্ত কুমার দাস বলেন, ‘আমরা এই ঘটনার বিচার চাই।’