এক দিন আগে হঠাৎ স্থগিত সিলেট জেলা বিএনপির সম্মেলন, নেপথ্যে কী
শেষ মুহূর্তে এসে এক দিন আগে হঠাৎ স্থগিত করা হয়েছে সিলেট জেলা বিএনপির সম্মেলন। আজ রোববার বেলা দেড়টার দিকে প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার। এবার সিলেটে বিএনপির সম্মেলন ঘিরে নানামুখী আলোচনা ও উত্তেজনা ছিল।
এদিকে সম্মেলনে সভাপতি পদপ্রার্থী সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর অনুসারীরা দাবি করছেন, সম্মেলনে প্রত্যক্ষ ভোটে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করার কথা ছিল। এতে সভাপতি পদে আরিফুলও প্রার্থী ছিলেন। তাঁর জয়ের সম্ভাবনা ছিল শতভাগ। মূলত আরিফুলকে আটকাতেই সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে।
আরিফুলের অনুসারীদের এমন দাবির বিষয়ে কামরুল হুদা জায়গীরদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন কোনো বিষয় আমার জানা নেই। মূলত ওপরের নির্দেশে সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে।’ বিএনপির আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, আজ রোববার ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এ তালিকা সময়মতো প্রকাশ করতে না পারায় সম্মেলন ও কাউন্সিল স্থগিত করা হয়েছে।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, কাল সোমবার জেলা বিএনপির সম্মেলন হওয়ার নির্ধারিত তারিখ ছিল। সে অনুযায়ী নগরের সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে সম্মেলন আয়োজনের যাবতীয় প্রস্তুতিও শেষ করা হয়। সম্মেলন উপলক্ষে নির্বাচনী পরিচালনা কমিটি তফসিলও ঘোষণা করেছিল।
তফসিল অনুযায়ী সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে প্রত্যক্ষ ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তিন শীর্ষ পদে লড়তে ১৩ জন মনোনয়ন ফরম জমাও দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সভাপতি পদে সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম ও যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ফরম জমা দেন।
স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের মতে, সিলেট বিএনপিতে বর্তমানে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদিরের একচেটিয়া কর্তৃত্ব রয়েছে। মুক্তাদিরের আধিপত্য বা নিয়ন্ত্রণ ভাঙা এবং দলের নেতৃত্বে আবার ফেরার লক্ষ্যে আরিফুল সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে, মুক্তাদির-বলয়ের প্রার্থী হচ্ছেন আবুল কাহের চৌধুরী। তাই আরিফুলের প্রার্থিতায় দলে নানা আলোচনা ও উত্তেজনা তৈরি করেছে।
বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের নেতৃত্বস্থানীয় একাধিক নেতা বলেন, আরিফুল প্রার্থী হয়েই সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এরপরই সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়। তাঁর জয়ের পাল্লা ক্রমে ভারী হতে থাকে। তবে কোনো কারণ ছাড়াই এক দিন আগে সম্মেলন স্থগিত করায় স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, মুক্তাদির আর আরিফুলের দ্বন্দ্বের জের ধরেই সম্মেলন স্থগিত হয়েছে।
জেলা বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১৮টি সাংগঠনিক ইউনিটের ১ হাজার ৮১৮ জন কাউন্সিলর সম্মেলনে সরাসরি ভোট দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করার কথা ছিল। সম্মেলনে সভাপতি পদে তিনজন, সাধারণ সম্পাদক পদে ছয়জন এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পদে চারজন মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সাধারণ সম্পাদক পদের এক নেতার ফরম বাতিল করা হয়।
আরিফুলের প্রার্থী হওয়ার পরই মূলত বিএনপির নেতা-কর্মীদের দৃষ্টি ছিল সভাপতি পদ ঘিরে। নেতা-কর্মীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে সিলেট বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নিয়ন্ত্রণ মুক্তাদির ও তাঁর অনুসারীদের হাতে আছে। মূলত, এ নিয়ন্ত্রণ ছোটাতেই একসময়ের প্রভাবশালী ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের স্নেহভাজন হিসেবে পরিচিত মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফুল হক চৌধুরী সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছেন। এ কারণে মুক্তাদিরের সমর্থকদের হিসাব-নিকাশ অনেকটা জটিল হয়ে ওঠে।
বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর আরিফুল হক রাজনীতি থেকে অনেকটা ছিটকে পড়েছিলেন। পরে দুই দফায় বিএনপির মনোনয়নে মেয়র নির্বাচিত হলেও দলে কর্তৃত্ব খুব একটা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এই ফাঁকে খন্দকার আবদুল মুক্তাদির ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁকে সিলেট-১ (মহানগর ও সদর) আসনে প্রার্থী করে বিএনপি। এ মুহূর্তে সিলেটে বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ মুক্তাদিরের হাতে। ফলে, এ সম্মেলন আরিফুল হক ও আবদুল মুক্তাদির—দুজনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সম্মেলন স্থগিত হওয়ার খবরে আরিফুল হক চৌধুরী ‘আশাহত’ হয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। এ বিষয়ে আবুল কাহের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভোটার তালিকা সময়মতো প্রকাশ করতে না পারায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে নতুন তারিখ ঘোষিত হবে। তবে খন্দকার আবদুল মুক্তাদির দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এর আগে ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে আবুল কাহের চৌধুরী সভাপতি, আলী আহমদ ও এমরান আহমেদ সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন। এরপর ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর কেন্দ্র থেকে জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি কামরুল হুদা জায়গীরদারকে আহ্বায়ক করে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। তিন মাসের মধ্যে তাঁদের সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের কথা ছিল।