কখনো ইটভাটায় কাজ করে, কখনো নদীতে মাছ ধরে, কখনো খেতখামারে দিনমজুরি করে সংসার চালান হাসান পারভেজ (৩৯)। কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাতে লিখে বের করেন চার পৃষ্ঠার একটি পত্রিকা, নাম আন্ধারমানিক। তাতে উঠে আসে স্থানীয় মানুষের জীবনকথা। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম সোনাতলা গ্রামের এই যুবকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নেছারউদ্দিন আহমেদ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পত্রিকা বের করতে কেন গেলেন, তা–ও আবার হাতে লিখে?
হাসান পারভেজ: গ্রামীণ জনপদের মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও সাফল্য তুলে ধরতেই পত্রিকা বের করছি। আরও একটি কারণ আছে। আমি কবিতা লিখি। তবে কোথাও ছাপাতে পারিনি। ভাবলাম, পত্রিকা বের করলে কবিতাও ছাপাতে পারব। ২০১৯ সালের ১ মে থেকে আমার পত্রিকা বের হচ্ছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পত্রিকার নাম ‘আন্ধারমানিক’ কেন দিলেন?
হাসান পারভেজ: আমার উপজেলার নদী ‘আন্ধারমানিকে’র নামে পত্রিকার নাম দিয়েছি। একটি স্লোগানও যুক্ত করেছি—‘আঁধারে মানিক্যের সন্ধান’।
প্রশ্ন :
আপনার পত্রিকার পাঠক কারা?
হাসান পারভেজ: শুরুতে শুধু পশ্চিম সোনাতলা গ্রামের মানুষকে পত্রিকাটি পড়াতে চেষ্টা করেছি। এখন পাশের আদমপুর, ফতেহপুর, হোসেনপুর, চাঁদপাড়া, নিজকাটা ও টুঙ্গিবাড়িয়া গ্রামের মানুষও আমার হাতে লেখা পত্রিকা পড়েন।
প্রশ্ন :
পত্রিকায় তো সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রতিবেদক বা রিপোর্টার থাকতে হয়। আরও অনেক কর্মী লাগে।
হাসান পারভেজ: আমার সঙ্গে ১৫ জনের মতো লোক কাজ করেন। বলতে পারেন, তাঁরাই আমার সংবাদকর্মী। কেউ কাঠমিস্ত্রি, কেউ দরজি, কেউ কৃষক, কেউ শ্রমজীবী, কেউ গৃহিণী। গ্রামে তাঁদের চোখে পড়া ঘটনা আমাকে বলেন। আমি লিখে দিই। তাঁরা কেউ টাকা নেন না।
প্রশ্ন :
পত্রিকা কীভাবে প্রকাশ করেন?
হাসান পারভেজ: আমার পত্রিকা বের হয় দুই মাস পরপর। প্রতিটি প্রতিবেদন আমি পত্রিকায় নিজের হাতে লিখি। শুধু শিরোনামগুলো কম্পিউটারে কম্পোজ করে দিই। পত্রিকা হাতে লেখার পর আমি মূল কপির ২০০ থেকে ২৫০টি ফটোকপি করি। অর্থসংকটসহ নানান কারণে কয়েকটি সংখ্যা বের করতে পারিনি। একটি ফটোকপিয়ার, ছবি তোলার জন্য একটি ক্যামেরা অথবা মোবাইল ফোন ও একটি কম্পিউটার থাকলে কাজটি সহজ হতো।
প্রশ্ন :
খরচ কত, আয় কিছু হয়?
হাসান পারভেজ: প্রতিটি কপির জন্য খরচ ৭ টাকা। এক সংখ্যা প্রকাশ করতে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৭৫০ টাকা ব্যয় হয়। একেকটি পত্রিকার দাম ১০ টাকা। সব কপি বিক্রি করা গেলে ৫০০ টাকার মতো লাভ থাকে।
প্রশ্ন :
আপনার পত্রিকায় প্রকাশিত কোন প্রতিবেদন আলোচিত হয়েছে?
হাসান পারভেজ: রুবিনা নামের ৯ বছরের একটি মেয়েকে নিয়ে লিখেছিলাম। তার মা ডলি বেগমকে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা হতো। কারণ, তাঁর মানসিক অসুস্থতা ছিল। পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র। তাঁদের দুঃখ-কষ্টের জীবন পত্রিকায় তুলে ধরি। পরে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন পরিবারটিকে একটি ঘর ও ২ শতাংশ জমি দিয়েছে। আমি গ্রামের মানুষের সাফল্যের খবর বেশি দিই।
প্রশ্ন :
পড়াশোনা কোথায় করেছেন?
হাসান পারভেজ: ১৯৯৬ সালে আমার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। অর্থাভাবে দিতে পারিনি। পরে ২০১৫ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছি। ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি (ভোকেশনাল) পাস করেছি। এখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকও করতে চাই।
প্রশ্ন :
পরিবারে কে কে আছেন?
হাসান পারভেজ: স্ত্রী ও দুই মেয়ে। বড় মেয়েটি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।
প্রশ্ন :
পত্রিকা বের করে তো সংসার চলে না, তাই না?
হাসান পারভেজ: পত্রিকা বের করি মনের আনন্দে। সংসার চলে কাজ করে। বলতে লজ্জা নেই, আমি কখনো ইটভাটায় কাজ করি। কখনো নদীতে মাছ ধরি, কখনো গ্রামের অবস্থাশালী পরিবারের গৃহস্থালির কাজ করি এবং খেতখামারের কাজ করি।
প্রশ্ন :
পত্রিকা কত দিন বের করতে চান?
হাসান পারভেজ: যত দিন পারি। আমি হাতে লিখেই পত্রিকা বের করব। তবে পৃষ্ঠা বাড়ানোর ইচ্ছা আছে। এখন আমি নিজ ঘরের বারান্দাকে কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছি। আলাদা একটি অফিস নিতে চাই।