‘আব্বু, এভাবে কেন চলে গেলে’
এভাবে বাবাকে হারিয়ে ফেলবেন, তা কল্পনাও করেননি মাহমুদা ফেরদৌস ও ফাতেমা আক্তার। করুণ বাস্তবতাকে মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল দুই বোনের। দুই বোনের আহাজারি থামানোর সাধ্য যেন নেই স্বজনদের।
মাহমুদা ফেরদৌস ও ফাতেমা আক্তার—ট্রাফিক পুলিশ মনির হোসেনর দুই মেয়ে। আজ শনিবার সকালে ডেমু ট্রেনের সঙ্গে তিন গাড়ির সংঘর্ষে মারা যান মনির হোসেন (৪৯)। চট্টগ্রাম নগরের জাকির হোসেন সড়কের ঝাউতলা রেল ক্রসিং এলাকায় দায়িত্বরত ছিলেন তিনি। এ ঘটনায় মনির হোসেনসহ মোট তিনজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাদরাজ উদ্দিন নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীও আছেন। আরেকজন সৈয়দ বাহা উদ্দিন প্রকৌশলী বলে জানা গেছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে আসা চট্টগ্রাম স্টেশনগামী ডেমু ট্রেনের সঙ্গে গাড়িগুলোর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় রেলগেটের এক পাশে লোহার বার ফেললেও অন্য পাশেরটা ফেলা হয়নি। এতে অটোরিকশা, টেম্পো ও বাস রেললাইনের ওপরে চলে আসে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্য মনির হোসেন গাড়িগুলো থামানোর চেষ্টা করছিলেন। ওই মুহূর্তে ডেমু ট্রেন চলে আসে। ট্রেন গাড়িগুলোকে কিছু দূর টেনে নিয়ে যায়। এতে মারা যান মনির হোসেন।
নিহত মনির হোসেনের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে মাহমুদাকে বিয়ে দিয়েছেন। আরেক মেয়ে ফাতেমা আগামী বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। চট্টগ্রাম নগরের চন্দ্রনগর আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় স্ত্রী–সন্তান নিয়ে থাকতেন মনির হোসেন।
মনির হোসেনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে স্বজনেরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ছুটে আসেন। মর্গের সামনে আগে থেকে উপস্থিত থাকা আত্মীয়স্বজনদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই বোন মাহমুদা ও ফাতেমা।
আহাজারি করতে থাকা বড় মেয়ে মাহমুদা ফেরদৌস বলেন, ‘আব্বু, তুমি এভাবে কেন চলে গেলে? আমার ভাই কারে আব্বু ডাকবে আল্লাহ। আম্মুকে এখন কে দেখবে?’ছোট মেয়ে ফাতেমার কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ। তার কথা, ‘বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটে। হাজার হাজার মানুষ মরে। তারপরও কেন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই এসব বলে কোনো লাভ নেই।’
আজ দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রেললাইনের একটু দূরে পুলিশ বক্স। সেখানে খুঁটির পাশে একটা সাইকেলে তালা লাগানো।
মনির হোসেন এই সাইকেল দিয়ে বাসা থেকে কর্মস্থলে আসতেন বলে জানান তাঁর সহকর্মী ও সার্জেন্ট আরাফাত আহমেদ। তিনি বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেলেন মনির হোসেন। এখন তাঁর সাইকেলটি পড়ে আছে। আর তিনি পড়ে আছেন মর্গে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মনির হোসেন তাঁর দায়িত্বের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। জীবনের শেষ মুহূর্তেও তার প্রমাণ রেখেছেন। গেটম্যান গেট না ফেললেও মনির হোসেন নিজ থেকে গিয়ে গাড়ি থামাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিতে হলো তাঁকে।
পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল সাদরাজের
ডেমু ট্রেনের সঙ্গে গাড়ির সংঘর্ষে নিহত এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাদরাজ উদ্দিনের স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর এই স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ পাবে না। মাত্র ১৮–তেই থেমে গেল তাঁর জীবন।
ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে স্বজনদের সঙ্গে মর্গে ছুটে আসেন সাদরাজের বাবা মোহাম্মদ করিম। ছেলের পাইলট হওয়ার স্বপ্নের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে দিয়ে দেন। কোনো ময়নাতদন্ত লাগবে না। আমার মানিককে বাড়িতে নিয়ে যাব।’
মুদিদোকানি মোহাম্মদ করিমের দুই ছেলের মধ্যে বড় সাদরাজ। কলেজে বিএনসিসির সদস্য ছিলেন। সাদরাজের বন্ধু মেহেদী হোসেন জানান, আজ সকালে কলেজে বিএনসিসির একটা সভা ছিল। ওটাতে যোগ দিতেই বাসা থেকে কলেজে যাচ্ছিলেন সাদরাজ। কিন্তু তার আগেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল।