নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের হাজীপুরে বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে চার বছরের শিশু তাসপিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অস্ত্রের জোগানদাতা সাকায়েত উল্যাহ ওরফে জুয়েলকে (২৯) গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল শনিবার দিবাগত রাত একটার দিকে উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জুয়েল ওই গ্রামের মৃত হাবিব উল্যাহর ছেলে।
গত বৃহস্পতিবার তাসপিয়া হত্যা মামলার প্রধান আসামি রিমন ওরফে মামুন উদ্দিন (২৩) নোয়াখালীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের তিন দিন আগে জুয়েলের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি অস্ত্র ভাড়া করার কথা স্বীকার করেন। ওই স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর পুলিশ জুয়েলকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সাবজেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল দিবাগত রাতে গোপন সংবাদের মাধ্যমে তাঁরা জানতে পারেন, অভিযুক্ত জুয়েল লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকায় অবস্থান করছেন। এরপর রাত একটার দিকে তাঁরা একটি বাড়ি থেকে জুয়েলকে আটক করেন।
পুলিশের পরিদর্শক সাবজেল হোসেন আরও বলেন, আটকের পর জুয়েলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাত সোয়া দুইটার দিকে দুর্গাপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের সোলেমানের পরিত্যক্ত ঘর (আসামিদের অপরাধের আস্তানা) থেকে দুটি কিরিচ, একটি রামদা এবং একই মামলার পলাতক আসামি মো. বাদশার টিনশেড ঘরের খাটের নিচ থেকে একটি পাইপগান ও দুটি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবজেল হোসেন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জুয়েল তাসপিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রিমনের কাছে অস্ত্র ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। জুয়েলের দাবি, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। রিমন কেন তাঁর নাম বলেছেন, তা–ও তিনি জানেন না। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, অস্ত্র ভাড়া দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেও জুয়েলের সঙ্গে অস্ত্রের সম্পর্ক আছে। তাঁর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
কে এই জুয়েল?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিশু তাসপিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অস্ত্রের জোগানদাতা হিসেবে অভিযুক্ত সাকায়েত উল্যাহ ওরফে জুয়েলের গ্রামের বাড়ি উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মৃত হাবিব উল্যাহ। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট জুয়েল। মেজ ভাই সোহেলকে ২০১৫ সালে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। সোহেল এলাকায় ‘উঠতি সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে সবাই ‘পিচ্চি সোহেল’ নামে চিনতেন।
লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জুয়েল পেশায় রংমিস্ত্রি হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর সঙ্গে বেগমগঞ্জের বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর গোপনে যোগাযোগ আছে। তা ছাড়া শিশু তাসপিয়া হত্যা মামলার প্রধান আসামি রিমনের অন্যতম সহযোগী রহিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জুয়েল। রহিমদের সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জুয়েলকে বিভিন্ন সময় দেখা যেত। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা আছে বলে তাঁরা শুনেছেন।
সূত্র জানায়, তাসপিয়া হত্যা মামলার প্রধান আসামি রিমনসহ তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে উপজেলার কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতার গোপনে যোগাযোগ আছে। রিমন ও তাঁর সহযোগীরা এলাকায় তাঁদের দাপট দেখিয়ে চলেন। ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করে বেড়ান তাঁরা। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণে নির্যাতিত হয়েও অনেকে তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন না।
বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর জাহেদুল হক দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, তাসপিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অস্ত্রের জোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত জুয়েলের বিরুদ্ধে থানায় তিনটি মারামারি ও একটি মাদকের মামলা আছে। গতকাল রাতে জুয়েলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের ঘটনায় থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
প্রসঙ্গত, ১৩ এপ্রিল বিকেলে শিশু তাসপিয়া আক্তারকে চিপস-জুস কিনে দিতে বেগমগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর মালেকার বাপের দোকান নামক স্থানে যান প্রবাসী আবু জাহের। তিনি তাঁর ভাগনে আবদুল্লা আল-মামুনের দোকানে কথা বলছিলেন। এ সময় পূর্ববিরোধের জেরে কয়েকজন সহযোগী নিয়ে সেখানে হামলা চালান রিমন। এ সময় জাহের মেয়েকে কোলে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে গুলি করেন রিমন। গুলিতে শিশু তাসপিয়ার মাথা ও মুখমণ্ডল ঝাঁঝরা হয়ে যায়। আর বাবা আবু জাহেরও চোখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকায় নেওয়ার পথে কুমিল্লায় তাসপিয়ার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় তাসপিয়ার খালু হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলায় রিমনসহ ১৭ আসামির নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে। মামলায় পুলিশ ও র্যাব এ পর্যন্ত ১০ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জন এজাহারভুক্ত আসামি।