রায় শুনে আধা ঘণ্টা মাথা নিচু করে বসে ছিলেন বিমর্ষ তানভীর-জেসমিন দম্পতি
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী জেসমিন ইসলাম। দুজন তখন আদালতকক্ষে পাশাপাশি বসে ছিলেন। তানভীর ছিলেন হুইলচেয়ারে বসা। আর জেসমিন বসা ছিলেন অন্য একটি বেঞ্চে। দুজন তখন মাথা নিচু করে থাকেন।
রায় ঘোষণার পর অন্তত ৩০ মিনিট এই দম্পতি কোনো কথা বলেননি। এ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তানভীরের ভায়রা তুষার আহমেদও কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
এক যুগ আগে সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় করা মামলায় হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, তাঁর স্ত্রী হল-মার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক আবুল কাসেম। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলো মনে করে, তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত বলে আদালত মনে করে। তবে সংশ্লিষ্ট আইনে এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন, তাই তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।
এ রায়কে যুগান্তকারী অভিহিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সরকারি কৌঁসুলি মীর আহমেদ আলী সালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় হল-মার্ক গ্রুপের তানভীরসহ অন্যরা সোনালী ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। আরও যেসব মামলা বিচারাধীন, সেগুলো শিগগির নিষ্পত্তি করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
৩০ মিনিট ধরে মাথা নিচু করে বসে ছিলেন তানভীর
ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা। রায় ঘোষণার জন্য এজলাসকক্ষে আসেন বিচারক। তানভীরসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে আদালত ঘোষণা করেন। এরপর আসামিদের দণ্ড ঘোষণা করে এজলাসকক্ষ ত্যাগ করেন বিচারক।
তখন হুইলচেয়ারে বসে থাকা তানভীর মাহমুদ নিশ্চুপ ছিলেন। কারও সঙ্গে তিনি কোনো কথা বলেননি। প্রায় ৩০ মিনিট তিনি মাথা নিচু করে বসে ছিলেন, যদিও তাঁর পাশে বসে ছিলেন স্ত্রী জেসমিন ইসলাম। পরবর্তীকালে তানভীরকে তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে দেখা যায়। প্রায় এক ঘণ্টা আদালতকক্ষে হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন তানভীর মাহমুদ।
তানভীরের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তানভীর এখন স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন না। তাঁর ঘাড়ে একটি টিউমার হয়েছে।
বেলা দুইটার দিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা পরোয়ানা হাতে পাওয়ার পর এজলাসকক্ষ থেকে আদালতের বারান্দায় আনা হয় তানভীর মাহমুদকে। তানভীরের পরনে ছিল সাদা শার্ট। এরপর তাঁকে ছয়তলার পশ্চিম পাশ থেকে হুইলচেয়ারে করে পূর্ব দিকে নিয়ে আসা হয়। সেখানে সিঁড়ির অংশে হুইলচেয়ার উঁচু করে তানভীরকে লিফটের সামনে আনা হয়। লিফট দিয়ে ছয়তলা থেকে তাঁকে নিচে নামানো হয়।
নিচতলায় লিফটের সামনের সিঁড়ির অংশে আবার হুইলচেয়ার উঁচু করে তানভীরকে আদালত ভবনের ফটকের কাছে আনা হয়। এরপর হুইলচেয়ারে করে তাঁকে বহনকারী গাড়ির কাছে নিয়ে আসতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। তবে আদালত ভবনের প্রবেশপথে রাখা প্রতিবন্ধকে (ব্যারিকেড) আটকে যায় তাঁর হুইলচেয়ার। তখন পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধক পার হন তানভীর। এরপর আবার তিনি হুইলচেয়ারে বসে পড়েন।
এ সময় তানভীর সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের কোনো টাকা আত্মসাৎ করেননি।
গণমাধ্যমকর্মীরা তানভীরের ছবি তুলতে গেলে তিনি ক্ষেপে যান। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘ছবি তোলা হয়েছে তো। আর কত ছবি তুলতে হবে?’ তানভীর আবারও বলেন, ‘আমি সোনালী ব্যাংকের কোনো টাকা আত্মসাৎ করিনি।’
এরপর তানভীরকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে যাওয়া হয় আদালত ভবনের পেছনের সড়কে (শাঁখারীবাজারের প্রবেশপথ)। সেখানে রাখা ছিল তাঁকে বহনকারী একটি মাইক্রোবাস। তখন হুইলচেয়ার থেকে তিনি মাইক্রোবাসে উঠে পড়েন। এরপর পুলিশ পাহারায় কারাগারের উদ্দেশে ছেড়ে যায় তানভীরকে বহনকারী মাইক্রোবাস। উল্লেখ্য, আদালতের অনুমতি নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে কারাগার থেকে যাতায়াত করেন তানভীর, জেসমিন ইসলাম ও তুষার আহমেদ।
তানভীরের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আবেদন করবেন তানভীর মাহমুদ ও জেসমিন ইসলাম। তিনি বিচারিক আদালত থেকে ন্যায়বিচার বিচার পাননি।
এক যুগ আগে সোনালী ব্যাংকের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ব্যাংকটির রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) হোটেল শাখা থেকে হল-মার্ক মোট ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এ ঘটনায় ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর হল-মার্ক গ্রুপের জেসমিন ইসলাম, তানভীর মাহমুদসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। মামলা হওয়ার এক যুগ পর আজ একটি মামলার রায় ঘোষণা হলো। এ মামলায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবিরসহ আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।