চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২৫ ভাগ ডেঙ্গু রোগী মশারি ব্যবহার করছেন না। চিকিৎসা দেওয়া সব হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য আলাদা কর্নারও নেই। এতে করে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছে। এ ছাড়া বাসাবাড়িতে ৫০ ভাগ মানুষ মশারি ব্যবহার করছে না। পাশাপাশি শহরের ২৫টি স্থানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ার কারণে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া আরও বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষকেরা।
সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে গবেষক দলটি চট্টগ্রামে মাঠপর্যায়ে জরিপ চালায়। এ সময় তারা ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দানকারী চারটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের সঙ্গে কথা বলে। এ ছাড়া মাঠপর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাড়িঘর পরিদর্শন করে এডিস মশার প্রজনন এবং মশারি ব্যবহার ও ডেঙ্গু সচেতনতার তথ্য সংগ্রহ করে। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন চিকিৎসক সুনম বড়ুয়া।
পাঁচ দিনের মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের পর গবেষক দলটি ঢাকায় ফিরে নমুনা পরীক্ষাসহ আনুষাঙ্গিক কাজ করে। প্রায় এক মাস পর আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরিনের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে তা চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের কাছে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ছয়টি সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদনটি আমাদের দেওয়া হয়েছে। তাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। রোগীদের মশারি ব্যবহার করা হয় না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গবেষক দলটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল, নেভি হাসপাতাল, সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিক পরিদর্শন করে ডেঙ্গু রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এ সময় তারা ডেঙ্গু রোগীদের শতভাগ মশারি ব্যবহার করতে দেখেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭৫ ভাগ রোগী মশারি ব্যবহার করছেন। হাসপাতালগুলোয় আলাদা ডেঙ্গু কর্নারও নেই। ফলে ডেঙ্গু রোগীকে কামড়ানো মশা সুস্থ কাউকে কামড়ানোর আশঙ্কা থেকে যায়। এ অবস্থায় ডেঙ্গু রোগীদের জন্য শতভাগ মশারি ব্যবহার নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ দল। নগরের বিভিন্ন বাসাবাড়ি পরিদর্শন করে মাত্র অর্ধেক লোক মশারি ব্যবহার করে বলে তথ্য পেয়েছে দলটি।
গবেষণা দলটি সিটি করপোরেশনের ৯টি ওয়ার্ড ও সাতকানিয়া উপজেলায় ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পায়। তবে বর্তমানে ডেঙ্গু রোগের বিস্তৃতি আরও বেড়েছে। এখন নগরের প্রায় সব জায়গা থেকে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালগুলোয়। এ ছাড়া সাতকানিয়া, কর্ণফুলী, পটিয়া, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন উপজেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।
২২৩ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে এই জরিপ গবেষণা চালানো হয়। এ সময় সবচেয়ে বেশি ৩২ শতাংশ রোগী মিলেছে নগরের ডবলমুরিং থানা এলাকায়। এ ছাড়া হালিশহরে ২০ শতাংশ, আগ্রাবাদে ১৮ শতাংশ, সাতকানিয়া ও বন্দর এলাকায় ২০ শতাংশ রোগী পাওয়া যায়।
৮০টি স্থান পরিদর্শন করে ২৫টি স্থানে ডেঙ্গুবাহী মশা এডিসের লার্ভা শনাক্ত করেছে গবেষক দল। এর মধ্যে ৩৫ ভাগ পেয়েছে খালি জায়গায়, মার্কেটের আশপাশে, বাস টার্মিনালে, যেখানে পানি জমা রয়েছে। ২৬ ভাগ লার্ভা পেয়েছে বহুতল ভবনে, ১৪ ভাগ পেয়েছে সেমি পাকা ভবনের আশপাশে, ২০ ভাগ লার্ভা পেয়েছে নির্মাণাধীন ভবনে। এ ছাড়া গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ারে ৭০ শতাংশ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। খালি বোতল, পাত্রসহ অন্যান্য কৌটায় বাকি ৩০ ভাগ লার্ভা মিলেছে।
সিভিল সার্জন বলেন, ডেঙ্গুর বিস্তার এখন আরও বেড়েছে। আইইডিসিআরের প্রতিবেদনটি আমরা সিটি করপোরেশন, হাসপাতাল, ডিসিসহ সব জায়গায় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি।
প্রতিবেদনে ৬ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা, এডিস মশার প্রজনন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া, হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার স্থাপন করে চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর মশারি ব্যবহার নিশ্চিত করা।
এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে শতাধিক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোর একপাশে মশারি টানিয়ে রোগীদের রাখা হয়। তবে সব রোগী মশারির ভেতর থাকেন না। সরেজমিনে গত মঙ্গলবার চমেক হাসপাতালের ১৪ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীর আশপাশে সাধারণ রোগীও রয়েছেন। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য মশারি রয়েছে। তবে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মশারির একপাশ তুলে গল্পগুজব করছেন। কেউ ঘোরাফেরা করছেন। নার্সরা তাগিদ দিলেও তাঁরা মশারির ভেতর থাকতে চান না। এ বিষয়ে কর্ত্যবরত এক চিকিৎসক বলেন, বারবার বলার পরও তাঁদের মশারির ভেতর রাখা যায় না। চট্টগ্রামে এ বছর সরকারি হিসেবে ১ হাজার ৭৪২ ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১২ জন মারা গেছেন।