প্রাচীন মুদ্রার খোঁজে
মানবজাতির প্রথম আনুষ্ঠানিক মুদ্রা কোনটি? মুদ্রাটির নাম লিডিয়ান সিংহ। আনুমানিক ৬০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে প্রাচীন লিডিয়া (বর্তমান তুরস্ক) রাজ্যের রাজা এলিয়াটিস প্রথম রাজধানী সারদিসের টাঁকশাল থেকে এই মুদ্রা চালু করেন।
এই মুদ্রাটিসহ বঙ্গের সর্বপ্রাচীন মুদ্রা, হরিকেল রাজ্যের প্রাথমিক মুদ্রা, এ অঞ্চলের দেশীয় রাজরাজড়াদের মুদ্রা, গৌড়, সমতট রাজ্যের মুদ্রা, প্রথম ইসলামিক মুদ্রাসহ বহু প্রাচীন মুদ্রার দেখা পাওয়া যাবে প্রদর্শনীতে। তিন দিনব্যাপী প্রাচীন মুদ্রার এই প্রদর্শনী শুরু হয়েছে রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে।
শৌখিন মুদ্রা সংগ্রহ একটি শখ ও নেশা। দুনিয়ার সব দেশেই এই শখের সংগ্রাহক রয়েছে। গড়ে উঠেছে মুদ্রাবিষয়ক শখের সংগঠন।
বাংলাদেশে মুদ্রা সংগ্রাহকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিউমিসম্যাটিক কালেক্টর সোসাইটি (বিএনসিএস), যেটি যাত্রা শুরু করেছিল ২০০৮ সালে। এদের আয়োজনে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে এই মুদ্রা প্রদর্শনী। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় পঞ্চমবারের মতো এ আয়োজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ কবীর আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মির্জা ইলিয়াসউদ্দিন আহমেদ। সভাপতিত্ব করলেন বিএনসিএসের সভাপতি মো. রবিউল ইসলাম।
প্রদর্শনীতে সারা দেশের ২৭ জন মুদ্রা ও একজন প্রাইজবন্ড সংগ্রাহকের সঙ্গে ৬ জন খুদে সংগ্রাহকের বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ ৩৭টি ডিসপ্লে বাক্সে ও ৭টি ডিসপ্লে বোর্ডে দর্শনার্থীরা দেখতে পাবেন। প্রদর্শনীতে এসব প্রাচীন মুদ্রার পাশাপাশি সংগ্রাহকেরাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ঘুরে ঘুরে দর্শকদের মুদ্রা সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছিলেন।
প্রদর্শনীর শুরুতেই ছিল প্যাসেফিক–ওশেনিয়া অঞ্চলের ১৮টি দেশের মুদ্রার সুবিশাল সংগ্রহ। এসব মুদ্রার সংগ্রাহক কামরুজ্জামান কায়সারকে পাওয়া গেল কাছেই। বললেন, কাগুজে নোটের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমে আসছে। চলে এসেছে ডিজিটাল মুদ্রা। মুদ্রা আবিষ্কার সভ্যতার আদিপর্ব থেকে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ চর্চার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এই মুদ্রা। সেই হিসেবে মুদ্রা প্রদর্শনী আমাদের অতীত ধরে রাখার একটি কার্যক্রম।
পাশেই সংগ্রাহক রবিউল ইসলামের বিশেষ প্রদর্শনী। আফ্রিকা মহাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে প্রিন্সেস ডায়ানার ছবিযুক্ত স্মারক মুদ্রা সংগ্রহ করেছেন তিনি।
প্রাচীন এই মুদ্রা কীভাবে সংগ্রহ করা হয়, জানতে চেয়েছিলাম মুদ্রাসংগ্রাহক জাহিদুর রহমানের কাছে। তাঁর কাছে রয়েছে সুলতানি শাসনামল, মোগল সাম্রাজ্য, ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিভিন্ন মুদ্রা ও নোট। জানালেন দুই পদ্ধতিতে তাঁরা সংগ্রহ করেন এসব মুদ্রা। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন স্থাপনা থেকে কিংবা মাটির নিচে কোনো স্থাপনা থেকে প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া গেলে সবার আগে তা পৌঁছায় স্বর্ণকারদের কাছে। তাঁদের মাধ্যমে মূলত তাঁরা এসব অমূল্য রত্নের খোঁজ পেয়ে থাকেন। এর বাইরে ভারত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত প্রাচীন মুদ্রার নিলামের আয়োজন করে বিভিন্ন নিলাম হাউস। ঢাকায় বসেই অনলাইনে সেসব নিলামে অংশ নেওয়া যায়। এ ছাড়া বিএনসিএসও মাঝেমধ্যে নিলামের আয়োজন করে। কিছু ধাতব মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করা হয় রুপার ওজন অনুসারে। আবার কিছু দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা আছে, নির্দিষ্ট কোনো দামে যেগুলোর মূল্যমান ঠিক করা যায় না।
প্রদর্শনীতে খুঁজে পাওয়া গেল মানবজাতির প্রথম আনুষ্ঠানিক মুদ্রা লিডিয়ান সিংহের সংগ্রাহক সুদীপ্ত পালকে। তিনি এমিরেটস এয়ারলাইনসের কার্গো সেলস এক্সিকিউটিভ। যুক্তরাজ্যের একটি নিলাম হাউস থেকে মুদ্রাটি সংগ্রহ করেছেন। সংগ্রহমূল্য প্রকাশ না করতে অনুরোধ করলেন তিনি।
প্রদর্শনীতে ধাতব মুদ্রার মধ্যে দর্শকেরা আরও দেখতে পাবেন প্রাচীন ভারতীয় ছাপাঙ্কিত মুদ্রা, মধ্যযুগীয় বাংলার সোনারগাঁ টাঁকশালের মুদ্রা, প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্যের মুদ্রা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অস্বাভাবিক আকারের, বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যের এবং রঙিন মুদ্রা। আর ব্যাংক নোটের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সব ডিজাইনের প্রচলিত ও নমুনা নোট, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ছোট প্রচলিত ও স্মারক ব্যাংক নোট, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিযুক্ত ব্যাংক নোট, ব্রিটিশ ভারতীয় ও পাকিস্তানের ১৯৪৭–৭১ সময়কার ব্যাংক নোট।
গতকাল দুপুরে প্রদর্শনী চলাকালে বিএনসিএসের আহ্বায়ক লেখক ও ঢাকা গবেষক সাদ উর রহমানকে পাশে রেখে, মোগল সম্রাটদের আমলের দুর্লভ কিছু মুদ্রা যার সংগ্রহে রয়েছে, সংগঠনটির সভাপতি রবিউল ইসলাম জানালেন, এই প্রদর্শনীতে আড়াই হাজার বছর আগে থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মুদ্রার ক্রমবিকাশ উপস্থাপন করা হয়েছে। তাঁর কথা, মূলত দুটি কারণে তাঁরা মুদ্রা প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকেন। এক. নতুন সংগ্রাহক সৃষ্টি করা, দুই. মুদ্রার প্রকারভেদ, আকার কত বৈচিত্রময় হতে পারে, তা মানুষকে জানানো।
তিন দিনের এই প্রদর্শনী শেষ হবে আগামীকাল শনিবার। নতুন প্রজন্মকে মুদ্রা ও এর ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করাতে একবার এই প্রদর্শনী ঘুরে আসা যেতেই পারে।