হুমায়ুন কবিরকে কেন হত্যা করেছিল সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি

হুমায়ুন কবির ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তরুণ শিক্ষক, কবি ও গবেষক। ১৯৭২ সালের ৬ জুন ইন্দিরা রোডের বাসার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। আজকের ফিরে দেখা সেই হত্যাকাণ্ড নিয়েই।

১৯৭২ সালের ৬ জুন, সময় রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। হুমায়ুন কবির স্ত্রী সুলতানা রেবু, ছেলে সেতু ও মেয়ে খেয়াকে নিয়ে থাকতেন ইন্দিরা রোডের একটি বাড়িতে। সেই রাতে অসহ্য গরম পড়েছিল। হুমায়ুন কবির কখনো খালি গায়ে থাকতেন না। শীত কি গরম, একটা গেঞ্জি থাকতই। কিন্তু সেই রাতে তিনি খালি গায়ে ছিলেন। সারা দিনের ক্লান্ত সুলতানা রেবু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাই কখন হুমায়ুন কবির খালি গায়ে বাইরে গেলেন জানতে পারেননি।

হুমায়ুন কবির বাসার সামনের খালি মাঠটায় শুয়ে ছিলেন, মনে হচ্ছিল প্রচণ্ড গরমে খানিকটা স্বস্তির আশায় খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছেন। বাড়িওয়ালা বা পাশের বাসার ছেলেটি বাইরে থেকে আসছিল। তারাই প্রথম দেখেন হুমায়ুন কবিরকে। দ্রুত এসে খবর দেন। একটা বেবিট্যাক্সি এনে দ্রুত নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে, কিন্তু বাঁচানো যায়নি। মাথার পেছনে ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছিল।

হুমায়ুন কবির ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তরুণ শিক্ষক। কবিতা লিখতেন। জীবনানন্দ দাশ নিয়ে গবেষণা করতেন। উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ কুসুমিত ইস্পাত ছাপা হয়েছিল মৃত্যুর পরে, ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে।

আততায়ী দুজন এসেছিলেন একটা সাইকেলে চড়ে। একজন মাঠেই ছিলেন, আরেকজন এসে কথা বলার জন্য ডেকে নিয়ে যান। লোকটি পরিচিত ছিলেন হুমায়ুন কবিরের কাছে, ফলে খালি গায়েই তিনি চলে যান তাঁর সঙ্গে সামনের মাঠে। মাঠে অপেক্ষায় ছিলেন আরেকজন। সম্ভবত তিনিই পেছন থেকে গুলি করেন হুমায়ুন কবিরকে।

স্ত্রী সুলতানা রেবু স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবে,

‘হুমায়ুন ওর প্রথম কবিতার বইটি (কুসুমিত ইস্পাত) প্রকাশিত হওয়ার আগে যত রকম শ্রম দেওয়া দরকার, তার সবটুকু দিয়েছিলে। বইটি ছাপা হওয়ার জন্য সব প্রস্তুতিই ছিল সম্পন্ন। ওই দিন সে কথা জানাতে গেলে ওর শেষ দেখা হয়েছিল সেলিম আল দীন ও আহমদ ছফার সঙ্গে। প্রচণ্ড গরমে ক্লান্তবিধ্বস্ত অবস্থায় হুমায়ুন বাড়ি ফিরে এলে সন্ধ্যা নাগাদ আমরা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত সাড়ে ১০টায় আমি যখন আমার বাড়িওয়ালা ও প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে গুলিবিদ্ধ হুমায়ুনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই, তার কিছু পরেই খবর পেয়ে হাসপাতালে অনেকে এসেছিলেন, যাঁদের মধ্যে আমি কেবল আহমদ শরীফ স্যারের কথা মনে করতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে হুমায়ুন চিরনিদ্রায় শায়িত আছে। কে জানত, একসময়ের প্রিয় আড্ডার জায়গাটিই হবে তার শেষশয্যা!’

আততায়ী দুজন এসেছিলেন একটা সাইকেলে চড়ে। একজন মাঠেই ছিলেন, আরেকজন এসে কথা বলার জন্য ডেকে নিয়ে যান। লোকটি পরিচিত ছিলেন হুমায়ুন কবিরের কাছে, ফলে খালি গায়েই তিনি চলে যান তাঁর সঙ্গে সামনের মাঠে। মাঠে অপেক্ষায় ছিলেন আরেকজন। সম্ভবত তিনিই পেছন থেকে গুলি করেন হুমায়ুন কবিরকে।

কে খুন করেছিল

হুমায়ুন কবিরকে হত্যা করেছিল পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। এই পার্টির প্রধান ছিলেন সিরাজ সিকদার। একটা সময় হুমায়ুন কবির জড়িত ছিলেন এই দলটির সঙ্গে। নানা কারণে পরে বিভেদ সৃষ্টি হলে পার্টির নির্দেশে খতম করা হয় তাঁকে। যদিও হুমায়ুন কবির তখন আর সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না।

সিরাজ সিকদার বরিশালের বিএম কলেজের ছাত্র ছিলেন। তখনই পরিচয় হয় হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠা বরিশালের আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারাবাগানে, ৩ জুন ১৯৭১, যুদ্ধের মধ্যে। আরও অনেক চীনাপন্থীদের মতো ভুল করেননি সিরাজ সিকদার। তাঁর নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৩ জুন বরিশালের স্বরূপকাঠির পেয়ারাবাগানে অনুষ্ঠিত এক গোপন সম্মেলনে সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন বিলুপ্ত করে গঠন করেছিলেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। টাঙ্গাইল, বরিশাল, মাদারীপুর, গৌড়নদী ও মঠবাড়িয়া অঞ্চলে দলটি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়।

ফিরোজ কবির ছিলেন হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাই। তাঁর এই কিশোর ভাইটিও ছিল সর্বহারা পার্টির অন্যতম সদস্য। ১৯৭১ সালে আগস্ট মাসে বরিশালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। ১৮ আগস্ট বরিশালে ব্যাপ্টিস্ট মিশন-সংলগ্ন খালপাড়ে দাঁড় করিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এই যুদ্ধের সময়েই সিরাজ সিকদারের মতের সঙ্গে মিল হয়নি ফিরোজ কবিরের। দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল ফিরোজ কবিরকে।

হুমায়ুন কবির ও কবিতার বইটির প্রচ্ছদ

হুমায়ুন কবির আর ফিরোজ কবিরের ছোট বোন আলমতাজ বেগম ওরফে ছবি। পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির আরেক সক্রিয় সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা। হাতের লেখা ভালো ছিল বলে ছবি পোস্টার লিখে দিতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনিও যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্রী, বয়স ১৬ বছর বা সামান্য বেশি। পার্টির আরেক সদস্য সেলিম শাহনেওয়াজ ছিলেন ফিরোজ কবিরের বন্ধু, একই সঙ্গে পড়তেন। সেলিম শাহনেওয়াজ ও ছবি, একে অপরকে পছন্দ করতেন।

সেলিম শাহনেওয়াজের সঙ্গে ছবির বিয়ে হয় রণাঙ্গনেই। ছবি পরে লিখেছেন,

‘একাত্তরের ২৮ মে। যুদ্ধের ক্যাম্পে গুলির শব্দ, বারুদের গন্ধের মধ্যেই বিয়ে হলো আমার। বর সহযোদ্ধা সেলিম শাহনেওয়াজ। সহযোদ্ধারা সবাই বেশ আনন্দ-ফুর্তি করে ফুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে আমাদের বিয়ে হয়েছে।’

বিরোধ যেভাবে শুরু

কেবল মতের মিল হয়নি বলে সর্বহারা পার্টিতে অসংখ্য খুনোখুনি হয়েছে। আর এর শুরুটা হয়েছিল হুমায়ুন কবিরের পরিবারটি দিয়েই। সে সময় পার্টিতে নিজেদের আড়াল রাখতে ভিন্ন নাম নিতেন সবাই। যেমন পার্টিতে সেলিম শাহনেওয়াজের নাম ছিল একাধিক। তবে তিনি ফজলু নামেই ছিলেন বেশি পরিচিত। তিনি ছিলেন বরিশাল-খুলনা এরিয়ার কমান্ডার, সর্বহারা পার্টির নির্বাহী কমিটির ৭ নম্বর সদস্য। ফিরোজ কবিরের পার্টি নাম ছিল তারেক। আলমতাজ বেগম ছবির নাম ছিল মিনু।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসের পরপরই দলের মধ্যে নেতৃত্ব, রণকৌশল ইত্যাদি নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় এবং উপদলের সৃষ্টি হয়। এ রকম একটি উপদল গঠন করেছিলেন ফজলু বা সেলিম শাহনেওয়াজ। সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সুলতান।
‘পার্টির লাইন সঠিক, তবে সিরাজ সিকদার প্রতিক্রিয়াশীল’—এই স্লোগান দিয়ে দলে আন্তপার্টি সংগ্রামের চেষ্টা চালায় ফজলু-সুলতান গ্রুপ। সিরাজ সিকদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেওয়া হয়। অন্যদিকে পার্টি থেকে ফজলু-সুলতানকে অভিযুক্ত করা হয় খুলনা এলাকায় উপদল গঠন, পার্টি কর্মী হত্যা ও সিরাজ সিকদারকে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার ষড়যন্ত্রে। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে কেন্দ্রীয় কমিটি ফজলু (সেলিম শাহনেওয়াজ), সুলতান (মাহবুব), জাফর (আজম) ও হামিদকে (মোহসিন) পার্টি থেকে বহিষ্কার করে। জুলাই মাসে একই অভিযোগে বহিষ্কার করা হয় ইলিয়াস, রিজভী, সালমা, মিনু (আলমতাজ বেগম ছবি) ও মনসুরকে।

সিরাজ সিকদার

কেন সিরাজ সিকদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

ফজলু-সুলতানের বিদ্রোহের কারণ ছিল একাধিক। পার্টি পরিচালনা নিয়ে মতভেদ তো ছিলই, প্রেম-বিয়েও একটা বড় কারণ ছিল। ফজলু বা সেলিম শাহনেওয়াজ আর ছবি বা মিনুর বিয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি মেনে নেয়নি। যদিও সিরাজ সিকদার প্রথম বিয়ে করেছিলেন একজন কৃষক কন্যাকে। সেই স্ত্রীকে ত্যাগ করে তিনি জাহানারা নামের একজনকে বিয়ে করে দল চালাতেন। জাহানারারও ছিল এটি দ্বিতীয় বিয়ে। এ নিয়েও বিরোধ দেখা দিয়েছিল।

‘ফজলু-সুলতান গ্রুপ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিপ্লবী কমরেড ও সহানুভূতিশীল, সিরাজ সিকদারের কাছ থেকে জবাব নিন’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা বের করেছিল। এর জবাব হিসেবে ১৯৭২-এর জুনে একটি বিবৃতি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কমরেড সিরাজ সিকদার যে ধরনের জীবনযাপন করেন, তা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কমরেডদের অধিকাংশের ইচ্ছেমতোই করেন। কমরেড সিরাজ সিকদারের ব্যক্তিগত জীবনসংক্রান্ত বিষয়াদি পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত। একজন সর্বহারা বিপ্লবী হিসেবে তিনি কখনো পার্টির নিকট মিথ্যা বলেননি। পার্টির অনুমতিসহ বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার কমরেডদের আছে।’

ফজলুর প্রেম ও বিয়ে প্রসঙ্গটি যে বিরোধের অন্যতম কারণ, তার বড় প্রমাণ হচ্ছে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত আরেকটি পার্টি দলিল। সেই পার্টি দলিলে বলা হয়েছিল, ‘ফজলু-সুলতান চক্র বলত যৌনকে কি অস্বীকার করা যায়? অর্থাৎ অপরিবর্তিত খুদে বুর্জোয়া মেয়ের সঙ্গে প্রেমকে যৌন কারণে বাদ দেওয়া যায় না। যৌন কারণে তাকে নিয়ে বিয়ে করতে হবে। অর্থাৎ বিপ্লব, পার্টি ও জনগণের ক্ষতি হবে জেনেও শুধু যৌন কারণে অপরিবর্তিত বুদ্ধিজীবী মেয়েদের বিয়ে করা, যৌনের কাছে আত্মসমর্পণ করা। ইহা হল যৌন স্বার্থের নিকট বিপ্লব, জনগণ ও পার্টি স্বার্থকে অধীন করা।’

দলিলে আরও বলা হয়, ‘ফজলু পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে যোগদানের কিছুদিন পরে পাস করলেই বিয়ে করা যাবে, এ কারণে সুবিধাবাদী হয়ে পরীক্ষা দেয়, খুদে বুর্জোয়াসুলভ পত্র লেখে, জেলে প্রেমিকার চিন্তায় বিভোর থাকে, জেল থেকে বেরিয়ে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরম নির্যাতনের সময় বিয়ের কাজে প্রাধান্য দেয়, ব্যক্তিস্বার্থে প্রেমিকাকে নিয়ে আসে, ফ্রন্টের দায়িত্ব ভুলে যেয়ে প্রেমিকার নিরাপত্তার জন্য নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে বাড়িতে যায়, সেখানে প্রেমিকার জন্য ফ্রন্টের দায়িত্ব ভুলে থেকে যায়, অর্থ-অস্ত্র হারায়, পরে পার্টি তাকে কাজ দিলে সেখানে প্রেমিকার চিন্তায় কাজে অমনোযোগ প্রদর্শন করে, শেষ পর্যন্ত উক্ত দায়িত্ব থেকে অপসারণ চায়, প্রেমিকাকে নিয়ে আকাশকুসুম কল্পনা করে, শেষ পর্যন্ত প্রেমিকার চিন্তায় আত্মহত্যা করতে পদক্ষেপ নেয়, মানসিক বিকার জন্মায়, প্রেমিকার অভিযোগে পার্টির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এভাবে ফজলু-সুলতান চক্র যৌন স্বার্থের নিকট বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে অধীন করে। এর পরিণতি কী? এর পরিণতি হলো ফজলু-সুলতান চক্র গঠন, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালানো, পার্টির অর্থ চুরি, শেষ পর্যন্ত পার্টি, বিপ্লব, জনগণের স্বার্থের ক্ষতি করা।’

১৯৭২ সালের মে মাসে প্রচারিত কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের এক ইশতেহারে বলা আছে, ‘ফজলু চক্রের সঙ্গে মিনু (ফজলু চক্রের স্ত্রী) পার্টি পরিত্যাগ করে পলায়ন করেছে।’

সেলিম শাহনেওয়াজের লাশ সুগন্ধা নদীতে ভাসলেও সেই খবর ছবি পেয়েছিলেন আরও তিন দিন পর। তাঁর বড় ভাই হুমায়ুন কবিরের মৃত্যুর পর। সেলিম শাহনেওয়াজ মারা যাওয়ার দুদিন আগেও হুমায়ুন কবিরের বাসায় স্ত্রীসহ গেছেন, খাওয়াদাওয়া করেছেন। সেই ছিল তাঁদের শেষ দেখা।

হত্যা করা হলো ফজলুকে

ফজলুর এই বিদ্রোহ মাত্র দুই মাস টিকে ছিল। ১৯৭২ সালের ৩ জুন সর্বহারা পার্টি তাদের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে সেলিম শাহনেওয়াজের খতম করার মধ্য দিয়ে। এই দিন বরিশালে হত্যা করা হয় ফজলুকে। ১৯৭২ সালের ১০ জুন এক বিশেষ ইশতেহারে এই খতমের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বীর গেরিলারা নিজস্ব উদ্যোগে ৩রা জুন ফজলু চক্রকে দেশীয় অস্ত্রের সাহায্যে খতম করে।’ বিশেষ সেই ইশতেহারের শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বীর গেরিলারা এই বিশ্বাসঘাতক চক্রকে খতম করে সর্বহারা পার্টির প্রথম প্রতিষ্ঠা দিবস উদ্‌যাপন করেছে।’ সফলভাবে ফজলুকে হত্যার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি পরে বরিশাল অঞ্চলের গেরিলাদের কাস্তে হাতুড়ি খচিত স্বর্ণপদক প্রদান করে।

সেলিম শাহনেওয়াজকে খতম করা হয় লঞ্চঘাটে। খতমের পর লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় সুগন্ধা নদীতে। সেই লাশ আর কখনো কেউ দেখেনি। সম্ভবত ঝালকাঠির লঞ্চঘাটে যাওয়ার আগেই সিরাজ সিকদারের অনুসারীরা সেলিম শাহনেওয়াজকে ধরে ফেলে। আলোচনার জন্য নিয়ে যায় লঞ্চঘাটে। সেখানেই খতম করা হয়। খতমের জন্য ছবিকেও খুঁজেছিল, কিন্তু না পাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি।

সেলিম শাহনেওয়াজের লাশ সুগন্ধা নদীতে ভাসলেও সেই খবর ছবি পেয়েছিলেন আরও তিন দিন পর। তাঁর বড় ভাই হুমায়ুন কবিরের মৃত্যুর পর। সেলিম শাহনেওয়াজ মারা যাওয়ার দুদিন আগেও হুমায়ুন কবিরের বাসায় স্ত্রীসহ গেছেন, খাওয়াদাওয়া করেছেন। সেই ছিল তাঁদের শেষ দেখা।

কেন হুমায়ুন কবিরকে হত্যা

হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ হচ্ছে ফজলুর স্ত্রী ছবি বা মিনুকে আশ্রয় ও সমর্থন দেওয়া। আরও একটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। আগেই বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে দল গঠনের পর পেয়ারাবাগানে হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাই ফিরোজ কবিরের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়েছিল সিরাজ সিকদারের সঙ্গে। তখন ফিরোজ কবিরকে বহিষ্কার করা হয়। অভিযোগ করা হয় যে এই বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও মেনে নেননি হুমায়ুন কবির।

হুমায়ুন কবিরকে খতম করার পর পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া বিশেষ বক্তব্যে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়, ‘সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ, নাম-যশ করার পুরোপুরি বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণ সম্পন্ন হওয়ায় স্বভাবতই হুমায়ুন কবিরের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য ছিল। তাঁর ইচ্ছা ছিল আরএসপি-এর নির্মল সেন ও প্রফেসর সিদ্দিকের মতো চাকুরী ও বুর্জোয়া জীবনযাপন করে সর্বহারা পার্টির নেতা হওয়া এবং লেখক হিসেবে নিজেকে জাহির করা। তার এই মনোভাব এবং তার ভাই ফিরোজ কবিরসংক্রান্ত পার্টির সিদ্ধান্ত তাকে প্ররোচিত করে ফজলু-সুলতান চক্রের সঙ্গে যুক্ত হতে।’

পার্টির পক্ষ থেকে দেওয়া সেই বক্তব্যে আরও বলা হয়েছে, ‘এক দিকে সে এ ধরনের কথা বলেছে আর অন্যদিকে ফজলু চক্র ও নিজের বোনকে আশ্রয় দিয়েছে। পার্টি ও নেতৃত্ববিরোধী অপপ্রচার ও জঘন্য ব্যক্তিগত কুৎসা-সংবলিত দলিলাদি লিখেছে, ছাপিয়েছে এবং বিতরণ করেছে, চক্রের প্রধান প্রতিক্রিয়াশীল বৃদ্ধিজীবী হিসাবে কাজ করেছে। তার উদ্দেশ্য ছিল চক্রান্তকারীদের চর হিসাবে গোপনে পার্টির মাঝে অবস্থান করা যাতে ফজলু চক্রের পতন হলেও সে পার্টির মাঝে লুকিয়ে থাকতে পারে এবং পার্টির বিরাটাকার ক্ষতিসাধন করতে পারে।’

প্রথমে খতমে অংশ নেওয়া গেরিলাদের পুরস্কৃত করা হলেও সর্বহারা পার্টি পরবর্তী সময়ে হুমায়ুন কবিরকে খতম করা ভুল ছিল বলে স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু তাতে তো আর মৃত ব্যক্তি ফিরে আসেন না।

বাঁচতে পারেননি সিরাজ সিকদারও। ১৯৭৫ সালের পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। নিহত হন পরেরদিন গভীর রাতে। পুলিশ তখন শুনিয়েছিল ক্রস ফায়ারের সেই চিরপরিচিত গল্প।

তথ্যসূত্র:
১. কুসুমিত ইস্পাত, হুমায়ুন কবির, বইপড়ুয়া
২. বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা, ১৯৪৮-৮৯, জগলুল আলম, প্রতীক
৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও নারী মুক্তিযোদ্ধারা, মেহেরুন্নেসা মেরী, ন্যাশনাল পাবলিকেশনস
৪. আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন সমগ্র: বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিতর্কিত অধ্যায়, রইসউদ্দিন আরিফ, পাঠক সমাবেশ
৫. সিরাজ সিকদার রচনা সমগ্র, শ্রাবণ প্রকাশনী
৬. বাংলাদেশ ১৯৭১, তৃতীয় খণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স
৭. কথ্য ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকেন্দ্র