এস এম সুলতান রুচিবোধ তৈরি করেছিলেন, আর কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন নান্দনিক শিল্পের রূপকার
এস এম সুলতান দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে রুচিবোধ জাগাতে পেরেছিলেন। আর শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর হাত ধরে শুরু হয়েছিল এ দেশের প্রচ্ছদশিল্প, বাংলা লিখনরীতির আধুনিকতার কাল।
বাংলাদেশ শিল্পকলা আয়োজিত ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে স্মরণ অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের প্রথম পর্বে উঠে এল এসব কথা।
আজ শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে এস এম সুলতান ও কাইয়ুম চৌধুরীকে স্মরণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এবারের আয়োজন।
প্রথম পর্বে শিল্পী এস এম সুলতানের জীবন ও নন্দনতত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী। তিনি তাঁর ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে এস এম সুলতানের জীবন ও নন্দনতত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন, ‘গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের যে রাজনৈতিক শক্তি আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, সে রাজনীতি ছিল সংস্কৃতিযুক্ত। কিন্তু বর্তমান সময়ের রাজনীতি ক্রমাগতভাবে সংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়ছে।’ তিনি বলেন, চিত্রকলাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে আপন করে তুলতে পেরেছিলেন সুলতান।
প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক কবি জাফর ওয়াজেদের বক্তব্যে উঠে আসে আশির দশকের সুলতানের জীবনধারার প্রসঙ্গ। একই সূত্রে তিনি সে সময়ে আহমদ ছফা এবং প্রয়াত বরেণ্য কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে এস এম সুলতানের ঘনিষ্ঠতা ও বিভিন্ন প্রদর্শনী আয়োজনের স্মৃতিকথাও উল্লেখ করেন।
এ পর্বের সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। দ্বিতীয় পর্বে আয়োজিত হয় বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মরণ অনুষ্ঠান। প্রথমে একটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় প্রয়াত এই গুণীজনের বহু কাজ, নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও শিল্প নিয়ে ভাবনার কথা।
এ পর্বে অধ্যাপক মামুন কায়সার পাঠ করেন ‘কাইয়ুম চৌধুরী নান্দনিক শিল্পের রূপকার’ শিরোনামে প্রবন্ধ। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রচ্ছদশিল্পের প্রকৃত আধুনিকতা শুরু হয়েছিল কাইয়ুম চৌধুরীর হাত ধরে। গ্রাফিক ডিজাইনে, বাংলা টাইপোগ্রাফিতে নতুন মাত্রা দিয়েছেন তিনি।’
মামুন কায়সার বলেন, শিল্পাচার্যের প্রিয় ছাত্র ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। নদী, নৌকা, নৌকার গলুই, মাছ, বৃক্ষ-পত্র-পুষ্প অবলীলায় খেলেছে কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রপটে। তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে শামসুর রাহমানের ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’, আল মাহমুদের ‘কালের কলস’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’–এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় সাহিত্যকর্মের প্রচ্ছদ। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভালো কিছু বের করে আনার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর।
কাইয়ুম চৌধুরীর সন্তান অধ্যাপক মইনুল ইসলাম জাবের বলেন, ‘আমার বাবা শিখিয়েছিলেন, নিজেকে কীভাবে দেখতে হয় এবং মানুষকে কীভাবে দেখতে হয়। শিল্পী হিসেবে তিনি অনেক সমাদৃত কিন্তু গ্রাফিক ডিজাইনে কাইয়ুম চৌধুরী কী অবদান রেখেছেন এবং তিনি এই মাধ্যমটিকে কীভাবে দেখতেন, তা আলোচনা হওয়া জরুরি।’ তিনি বলেন, একজন শিল্পী হিসবে কাইয়ুম চৌধুরী গ্রাফিক ডিজাইনের মাধ্যমে নিজের আদর্শ ও ভাবনা পৌঁছে দিয়েছেন।
এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন নন্দনতত্ত্ববিদ বুলবন ওসমান। তিনি বলেন, মানুষের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে তাঁর দেখার দৃষ্টি এবং অন্তরের অনুভব। শিল্পকলার ব্যবহার ও নান্দনিকতাকে সমন্বিত করে দেখতে হবে।
শিল্পকলা আয়োজিত এই স্মরণ অনুষ্ঠান চলবে আগামী ১২ জুন পর্যন্ত। এবারের ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ আয়োজনে স্মরণ করা হবে ৬২ জন বরেণ্য মনীষীকে।