এগিয়ে নিতে হবে ক্ষুদ্র চা শিল্প

‘ক্ষুদ্র চা শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৌশল নির্ধারণ ও বিনিয়োগে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) এম শাহ আলম, সেলিম রেজা হাসান, মো. আমির হোসেন ও কামরান তানভিরুর রহমান। গতকাল ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

প্রায় দুই যুগ আগে উত্তরাঞ্চলের জেলা পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। সেখানে শুরুতে কৃষকেরা লাভবান হলেও এখন বিপাকে রয়েছেন। চাষিদের দাবি, তাঁরা চায়ের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। তবে চা উৎপাদকেরা বলছেন, পঞ্চগড়ে উৎপাদিত চায়ের মান ভালো না। এ ছাড়া বর্তমানে চাহিদার তুলনায় চায়ের সরবরাহ বেশি। এ বিষয়গুলো সমাধান হলে চাষিরা ন্যায্যমূল্য পাবেন।

গতকাল রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে চা খাত নিয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এমন পর্যালোচনা উঠে আসে। সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক ও প্রথম আলোর যৌথ আয়োজনে ‘ক্ষুদ্র চা শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৌশল নির্ধারণ ও বিনিয়োগে করণীয়’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহযোগিতা করেছে নেদারল্যান্ডস সরকার।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সলিডারিডাড নেটওয়ার্কের কান্ট্রি ম্যানেজার সেলিম রেজা হাসান জানান, ২০২১ সাল থেকে উত্তরবঙ্গে ক্ষুদ্র চা–চাষিদের নিয়ে কাজ করছে সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক। এ সময় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা পাওয়া গেছে। এগুলো আলোচনার মাধ্যমে এ খাতের জন্য জাতীয়ভাবে একটি পথনির্দেশিকা তৈরি করা যেতে পারে।

গোলটেবিলে উত্তরবঙ্গে চা চাষ নিয়ে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মো. আতিকুজ্জামান। বৈঠকে বক্তারা বলেন, উত্তরবঙ্গে চা–গাছের ফলন ভালো হলেও সেখান থেকে ভালো মানের পাতা কারখানায় যায় না। এ ক্ষেত্রে পাতা তোলার দক্ষ শ্রমিকের অভাব, সরবরাহ ব্যবস্থায় দুর্বলতা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যসহ বেশ কিছু কারণ রয়েছে। চায়ের বাজার ঠিক রাখতে হলে এসব সমস্যা সমাধান করা জরুরি।

মান বাড়ানোয় জোর

বৈঠকে চায়ের মান বাড়ানোর ওপরে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন বড় ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ বটলিফ চা কারখানা মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবুল মনসুর বলেন, পঞ্চগড়ের চা–পাতায় তৈরি চায়ের মান ভালো নয়। এ কারণে নিলামে এ চা ভালো দামে বিক্রি করা যায় না। ভালো চায়ের জন্য দরকার দুই পাতা ও এক কুঁড়ি; অথচ পঞ্চগড়ে সাত-আট পাতা পর্যন্ত সংগ্রহ করেন চাষিরা।

ট্রেড ক্র্যাফটের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর শাহেদ ফেরদৌস বলেন, চা চাষ পঞ্চগড়ের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি উন্নত করেছে। তবে প্রথম থেকেই সেখানে যথাযথ নিয়ম মেনে চায়ের আবাদ হয়নি। ফলে এই জেলায় চায়ের সম্ভাবনা ধরে রাখতে অবশ্যই মান উন্নয়নে জোর দিতে হবে।

অন্যদিকে চায়ের মান ভালো না হওয়ার জন্য দায়ী করা হলেও চাষিদের দক্ষতা বাড়াতে তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না বলে জানান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র চা বাগান মালিক ও চা ব্যবসায়ী সমিতির (পঞ্চগড়) সভাপতি আমিরুল হক খোকন। তিনি বলেন, চা কৃষিপণ্য হলেও তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত। এ কারণে চা–চাষিরা কৃষি খাতে দেওয়া সরকারের কম সুদের ঋণসহায়তাসহ অন্যান্য সুবিধা পান না। এসব বিষয় সমাধান করা প্রয়োজন।

চা–চাষি ও চা–ব্যবসায়ী ফোরাত জাহান সাথী বলেন, পঞ্চগড়ে চা–চাষিদের অধিকাংশেরই চাষপদ্ধতি ও পাতা উত্তোলনের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। এ ছাড়া কারখানা পর্যন্ত পাতা পরিবহন করে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সরবরাহে সমস্যা রয়েছে। এসব কারণে ভালো মানের চা পাওয়া যায় না। আর সিন্ডিকেট করে পঞ্চগড়ের চায়ের দাম কমানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জেলার সোনাপাতিলা এলাকার চা–চাষি শাহজাহান খান।

চাহিদা-সরবরাহে ভারসাম্য নেই

বৈঠকে চা উৎপাদকেরা জানান, সরকার আরও কয়েকটি জেলায় নতুন করে চায়ের আবাদ বাড়াতে চায়। অথচ বর্তমানে কারখানাগুলোতে মোট উৎপাদিত চায়ের ৩০ শতাংশই অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। এভাবে চললে ভবিষ্যতে পাট খাতের মতো অবস্থা তৈরি হতে পারে।

চা–বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান তানভিরুর রহমান বলেন, শুধু চায়ের উৎপাদন বাড়ালেই হবে না, সেই চা ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাল কি না, তা দেখতে হবে। বর্তমানে কারখানায় উৎপাদিত চা পুরোপুরি বিক্রি হচ্ছে না। ফলে নতুন করে আট জেলায় চা উৎপাদন শুরু হলে তা এ খাতে বিপর্যয় নিয়ে আসবে।

ইএসডিওর প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক মো. শহিদ-উজ-জামান বলেন, পঞ্চগড়ে চা–বাগান এলাকায় পর্যটন সম্ভাবনা রয়েছে। এটিকে কাজে লাগানো গেলে সংশ্লিষ্টদের আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হবে।

দাম বাড়ানোর পরামর্শ

নিলামের সময় প্রতি কেজি চায়ের সর্বনিম্ন দাম ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। তবে এ দাম আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে জানান বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা ও ইনচার্জ মো. আমির হোসেন। তিনি বলেন, চায়ের সর্বনিম্ন দাম ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা যেতে পারে।

নিলামের সময় চায়ের নমুনার স্বাদ নেন টি টেস্টার। তাঁরা পঞ্চগড়ে উৎপাদিত চায়ের মান ভালো নয় বলে জানান। এ নিয়ে আপত্তি রয়েছে চাষিদের। এ জন্য তাঁরা স্থানের উল্লেখ না করে কোড নম্বর ব্যবহার করে চায়ের মান যাচাইয়ের দাবি জানান।

বৈশ্বিক ও দেশীয় বাজার ধরতে উন্নত প্রজাতির (জিন) চা চাষ ও বৈচিত্র্যময় চা উৎপাদনের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকায় নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কৃষি ও পুষ্টিনিরাপত্তা শাখার জ্যেষ্ঠ পলিসি অ্যাডভাইজার ওসমান হারুনি। তিনি বলেন, সমবায়ের ভিত্তিতে ভালো মানের চা উৎপাদন করা গেলে চায়ের দাম নিয়ে সংকট কমবে।

ডানকান ব্রাদার্স (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ডিরেক্টর অব অপারেশনস এম শাহ আলম বলেন, ‘শুধু উত্তরাঞ্চল নয়, দেশের পুরো চা খাতেই আমরা ব্যবসা হারাচ্ছি। ভালো মানের চা উৎপাদনের পাশাপাশি চায়ের চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য আনতে পারলে এ সমস্যা দূর হবে।’

অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে আরও ছিলেন বাংলাদেশ বটলিফ চা কারখানা মালিক সমিতির মহাসচিব নিয়াজ আলি চিশতি, গ্রিন ফিল্ড টি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফয়জুল ইসলাম, পঞ্চগড়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র চা বাগান মালিক ও চা ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক এ বি এম আখতারুজ্জামান, সুপ্রিম টি লিমিটেডের তৌফিক হাসান এবং সলিডারিডাড নেটওয়ার্কের উপদেষ্টা ফয়জুল মতিন, প্রতিষ্ঠানটির পলিসি অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিসোর্স মবিলাইজেশনের লিড ইপ্সিতা হাবিব ও প্রতিষ্ঠানটির পঞ্চগড় জেলার স্মল হোল্ডার টি প্রজেক্টের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল আলম।

এ ছাড়া ক্ষুদ্র চা–চাষিদের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থেকে পঞ্চগড়ের চা–চাষিদের সমস্যা তুলে ধরেন মো. রফিকুল ইসলাম, ইমরান আলি চৌধুরী, আবু হানিফা, কবিরুল ইসলাম, শাহীনুর রহমান তরিকুল, দেওয়ান রহমান ও মো. রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। সবশেষে চা শিল্পের বিকাশে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান।