২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মাছ চাষে লবণের ব্যবহার, উত্তরাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণাক্ততা

পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণায় মাছ চাষের পুকুরে লবণ দেওয়ার কারণে পার্শ্ববর্তী ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে।

দেশের উত্তরাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাম্প্রতিক এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। যে এলাকাগুলোর পুকুরে মাছ চাষে লবণ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তার কাছাকাছি ভূগর্ভস্থ পানি পরীক্ষা করে লবণাক্ততার উচ্চ মাত্রা পেয়েছেন সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইতিমধ্যে বড় ভাবনার বিষয়। কিন্তু উপকূল থেকে অনেক দূরের উত্তর জনপদে লবণাক্ততার এ চিত্রকে ‘বিস্ময়কর’ ও ‘বিপজ্জনক’ বলছেন পানি, মাটি ও পরিবেশবিজ্ঞানীরা। সুপেয় পানি, চাষাবাদ, সর্বোপরি উত্তরের মানুষের জীবনযাপনের ওপর লবণাক্ততা ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

এ অবস্থার মধ্যে আজ ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শান্তির জন্য পানি’।

কীভাবে হলো গবেষণা

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান দপ্তর দেশের প্রায় এক হাজার এলাকা থেকে নিয়মিত পানির নমুনা সংগ্রহ করে। মাস ছয়েক আগে উত্তরাঞ্চলের পানির স্তরে লবণাক্ততার পরিমাণ হঠাৎ করেই একটু বেশি দেখা যায়। পানিবিজ্ঞান দপ্তরের পরিচালক আনোয়ার জাহিদ বিষয়টি লক্ষ করেন। তিনি বলছিলেন, ‘তখন একটু খটকা লাগায় নতুন আরেকটি মেশিন দিয়ে পানি পরীক্ষা করি। আবারও একই ফলাফল পেলাম। যেখানে পরীক্ষাটি করা হয়, এর পাশেই ছিল মাছ চাষের পুকুর।

তখন একটু খটকা লাগায় নতুন আরেকটি মেশিন দিয়ে পানি পরীক্ষা করি। আবারও একই ফলাফল পেলাম। যেখানে পরীক্ষাটি করা হয়, এর পাশেই ছিল মাছ চাষের পুকুর। স্থানীয় পুকুরের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, পুকুরে বিশেষ করে শীতের সময় মাছের একধরনের রোগ প্রতিরোধে লবণ দেওয়া হয়। তখন সন্দেহটা আরও পোক্ত হলো। ভাবলাম এ নিয়ে বড় কাজ করা দরকার।
পানিবিজ্ঞান দপ্তরের পরিচালক আনোয়ার জাহিদ

স্থানীয় পুকুরের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, পুকুরে বিশেষ করে শীতের সময় মাছের একধরনের রোগ প্রতিরোধে লবণ দেওয়া হয়। তখন সন্দেহটা আরও পোক্ত হলো। ভাবলাম এ নিয়ে বড় কাজ করা দরকার।’

পানি সংগ্রহ করার পর এর লবণাক্ততা পরীক্ষা করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষকেরা
ছবি: পানি উন্নয়ন বোর্ডের সৌজন্যে

এরপর পানিবিজ্ঞান দপ্তর উত্তরবঙ্গের রাজশাহীর পুঠিয়া, বাগমারা ও দুর্গাপুর, নওগাঁর আত্রাই, নাটোরের সিংড়া ও নলডাঙ্গা উপজেলায় গবেষণা করে।

গবেষণাটি প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া একেবারে নতুন এক বিপদের দিকে আমাদের সজাগ করেছে। এভাবে লবণাক্ততা বাড়তে থাকলে পানির স্বল্পতায় থাকা উত্তরাঞ্চলে সমস্যা বাড়তে পারে। শস্য উৎপাদনেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, পানিবিশেষজ্ঞ

গবেষণার ফলাফল

ছয় উপজেলার ৪৯টি পুকুরের কাছে ১০০ ফুট গভীরের ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থা দেখা হয় গবেষণায়। ইসি বা ইলেকট্রিক্যাল কনডাকটিভিটি হলো মাটিতে লবণাক্ততা মাপার সাধারণ পদ্ধতি। লবণাক্ততা বেশি হলে ইসির পরিমাণ বাড়ে। বাংলাদেশের মানদণ্ড অনুযায়ী সুপেয় বা খাওয়ার পানির ক্ষেত্রে ইসি প্রতি সেন্টিমিটারে ২০০০ মাইক্রোসিমেন্স হলে তা সহনীয় মাত্রার মধ্যে পড়ে। আর চাষের পানির জন্য এর মাত্রা প্রতি সেন্টিমিটারে ৩০০০ মাইক্রোসিমেন্স। ৪৯টি পুকুরের নমুনার কোথাও ২০০০–এর ওপরে পাওয়া যায়নি। কিন্তু যেখানে আগে ২০০ থেকে ৩০০ মাইক্রোসিমেন্স ছিল, সেখানে দ্বিগুণ বা তিন গুণের বেশি হয়ে গেছে।

পানির লবণাক্ততা পরীক্ষায় এ যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়
ছবি: পানি উন্নয়ন বোর্ডের সৌজন্যে

উপজেলাগুলোর মধ্যে নওগাঁর আত্রাই, রাজশাহীর দুর্গাপুর এবং নাটোরের সিংড়ায় সর্বোচ্চ ইসির পরিমাণ ১১০০–এর ওপরে।

নাটোরের সিংড়া উপজেলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যেসব পুকুরে লবণের ব্যবহার কম হয়, সেখানে ইসির পরিমাণ ৫৭৬ থেকে ৬৬৬–এর মধ্যে। আর যেসব পুকুরে লবণের ব্যবহার হয়, সেখানে এর পরিমাণ ৮০৬ থেকে ১১০০–এর মধ্যে।

যেসব পুকুরে দীর্ঘ সময় ধরে লবণ ব্যবহৃত হয়, যেগুলোতে কম সময় ধরে ব্যবহৃত হয় এবং যেগুলোতে একেবারেই হয় না—এমন তিন ধরনের পুকুরের নিকটবর্তী ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে, যেসব পুকুরে দীর্ঘ সময় ধরে মাছ চাষ হয় এবং লবণের ব্যবহার আছে, সেগুলোর কাছের ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা অপেক্ষাকৃত বেশি।

পানিবিজ্ঞানী আনোয়ার জাহিদের (ডানে) নেতৃত্বে গবেষক দল
ছবি: পানি উন্নয়ন বোর্ডের সৌজন্যে

নাটোরের সিংড়া উপজেলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যেসব পুকুরে লবণের ব্যবহার কম হয়, সেখানে ইসির পরিমাণ ৫৭৬ থেকে ৬৬৬–এর মধ্যে। আর যেসব পুকুরে লবণের ব্যবহার হয়, সেখানে এর পরিমাণ ৮০৬ থেকে ১১০০–এর মধ্যে।

লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়াটা ভূপৃষ্ঠের পুরুত্ব ও ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে বলে মন্তব্য করেন গবেষণা দলের সদস্য মো. শাহাদাত আলী। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ছয় উপজেলার মধ্যে বাগমারা উপজেলা পড়েছে বরেন্দ্র ভূমির মধ্যে। এর ঘন ও পুরু লাল কাদার স্তর লবণাক্ততা ছড়াতে বাধার সৃষ্টি করে। তাই বাগমারা অঞ্চলের পুকুরগুলোয় লবণাক্ততার পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। দেখা গেছে, এই এলাকার যেসব পুকুরে দীর্ঘ সময় ধরে লবণ দেওয়া হতো, সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানিতে ইসি ৭৪৫–এর বেশি হয়নি।

মৎস্য চাষে লবণ, যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার শিমলা এলাকায় আটটি পুকুরে মাছের চাষ করেন আসাদুজ্জামান। তিনি জানান, প্রতিবছর নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে পুকুরের মাছের গায়ে একধরনের ঘা হয়। তখন মৎস্য কর্মকর্তাদের পরামর্শেই তিনি লবণ দেন। প্রতি বিঘায় ৫ কেজির মতো লবণ দেন তিনি। তবে লবণের কারণে মাটির গভীরে পানিতে লবণাক্ততার সমস্যা হচ্ছে বলে তাঁর জানা নেই।

বাগমারা উপজেলার মোহাম্মদ রফিকেরও একই কথা। শীতের সময় এলে তিনি প্রতি বিঘায় ৫ থেকে ৮ কেজি লবণ দেন বলে জানান।

মাটির লবণাক্ততা নিয়ে গবেষণার কাজ করেছেন মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জি এম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মাটির অন্তপ্রবাহের মাধ্যমে লবণাক্ত পানি যেমন ছড়াতে পারে, আবার পুকুরগুলো বন্যার সময় উপচে আশপাশের এলাকায় চলে যেতে পারে। এভাবেও লবণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

ছয় উপজেলার মধ্যে বাগমারা উপজেলা পড়েছে বরেন্দ্র ভূমির মধ্যে। এর ঘন ও পুরু লাল কাদার স্তর লবণাক্ততা ছড়াতে বাধার সৃষ্টি করে। তাই বাগমারা অঞ্চলের পুকুরগুলোয় লবণাক্ততার পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম।
গবেষণা দলের সদস্য মো. শাহাদাত আলী

দেশের প্রায় পুরো অঞ্চলে মাছ চাষ হয়। দেশের সুপেয় পানির মাছের ৫৭ ভাগই চাষের মাছ। দেশে ২৫ লাখ ১৯ হাজার ৮৭২ পুকুরে মাছ চাষ হয় বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়।

পুকুরে লবণ দেওয়ার বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মৎস্য চাষ) অলক কুমার সাহা বলেন, ‘শীতের সময় একধরনের ছত্রাক দেখা দেয় মাছে। সে জন্য আমরা পুকুরে লবণ দিতে বলি। এটি ছত্রাক থেকে মাছ বাঁচায়।’

তবে পুকুরে লবণ দেওয়ার কারণে পুকুরের নিকটবর্তী এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের পরিমাণ বাড়ছে তা কতটুকু ঠিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এখানে এত বেশি লবণ দেওয়া হয় না যে তা ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রবেশ করবে। তবে এ নিয়ে বিস্তৃত গবেষণার দরকার।

দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন না গবেষণা দলের প্রধান আনোয়ার জাহিদও। তাঁর কথা, ‘আমরা বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই কাজ করেছি। আর এর ফলাফল আশঙ্কাজনক। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পুকুর আছে। সেখানে লবণের প্রয়োগও ঘটছে। তাই এ নিয়ে আরও গবেষণা হতে পারে।’

শীতের সময় একধরনের ছত্রাক দেখা দেয় মাছে। সে জন্য আমরা পুকুরে লবণ দিতে বলি। এটি ছত্রাক থেকে মাছ বাঁচায়।
মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মৎস্য চাষ) অলক কুমার সাহা

শস্য উৎপাদনে প্রভাব পড়তে পারে

পুকুরে লবণের ব্যবহার ভূগর্ভস্থ স্তরে লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করতে পারে বলেই মনে করেন গবেষকেরা। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই গবেষণাকে একাধারে বিস্ময়কর ও বিপদের বলে মনে করেন পানিবিশেষজ্ঞ ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণাটি প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া একেবারে নতুন এক বিপদের দিকে আমাদের সজাগ করেছে। এভাবে লবণাক্ততা বাড়তে থাকলে পানির স্বল্পতা থাকা উত্তরাঞ্চলে সমস্যা বাড়তে পারে। শস্য উৎপাদনে এর প্রভাব পড়তে পারে। সর্বোপরি মানুষের জীবনযাপনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব আসতে পারে।’