মুক্তিযুদ্ধের গল্প
সিক্সটিনথ ডিভিশন
পাকিস্তানের নৃশংস সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে একাত্তরের এই দিনে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল এ দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের বুকে ছিল মৃত্যুকে উপেক্ষা করার সাহস, অন্তরে মুক্তির স্বপ্ন। স্বাধীন দেশে বারবার পরাহত হয়েছে সেই স্বপ্ন। খোলা চোখে মুক্তিযুদ্ধের অবলোকন নিয়ে এই লেখা।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে বড় আপার সঙ্গে টেবিল থেকে প্লেট-বাটিগুলো রান্নাঘরে রেখে আসতে গিয়েছিল রিমি, এমন সময় বেশ নিচু দিয়ে গর্জন করে ছুটে যায় দুটি প্লেন। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখা যাওয়া খোলা মাঠের ওপরের অন্ধকার আকাশে একঝলকের জন্য দেখা যায় হাউইয়ের মতো ছুটে যাওয়া একঝাঁক বাতি। প্লেনগুলোর দ্রুতগতি ও গর্জনে রিমি বুঝতে পারে, ওগুলো যুদ্ধবিমান। কিন্তু হেমন্তের এই শীতরাতে কোথায় গেল ওগুলো, গেল নাকি এল—সেটাও বোঝা যায় না। বড় আপা একটু ভয়ার্ত গলায় বলেন, ‘এই রাতের বেলায় ফাইটার প্লেন কোথায় যায়?’
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চলে আসার পরও সব সময় কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকেন আপা। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির সুবাদে দুলাভাইয়ের পোস্টিং হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান। ২৫ মার্চের পর থেকে প্রতিমুহূর্ত যে আতঙ্কে কেটেছে সেখানে, সেটা এখনো ছেড়ে যায়নি। বহু ধরাধরি করে মাসখানেক আগে পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হয়ে এসেছেন দুলাভাই। সেই থেকে এখানেই থাকছেন, নতুন বাসা নেননি এখনো। মা-বাবা দুজনই প্রায় জোর করে এ বাসায় রেখে দিয়েছেন ওঁদের। মার্চের পর থেকে ভাইয়া নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর খুব ভেঙে পড়েছিলেন মা। তারপর একদিন খুব কৌশলে ঢাকার বাইরে থেকে এক বন্ধুর মারফত পাঠানো খবর পেয়ে কিছুটা সুস্থির হয়েছেন। তবু প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন। গ্রামে গ্রামে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে, কী খাচ্ছে, কেমন আছে ছেলেটা!
বাবা একটু বিরক্ত গলায় বলেছিলেন, ‘তোমাদের বয়সী ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ করছে, আর তোমরা ক্রিকেট ক্লাব বানাচ্ছ। ব্যাপারটা কেমন ভেবে দেখেছ একবার?’ ওরা কোনো উচ্চবাচ্য করেনি, মাথা নিচু করে ফিরে গিয়েছিল।
প্রায় দৌড়ে রান্নাঘর থেকে এসে রিমি দেখে বাবা ততক্ষণে রেডিও খুলে বসেছেন। খুব নিচু শব্দে শুনছেন কিছু। দুলাভাইয়ের মুখ কিছুটা চিন্তিত, মায়ের চেহারায় কেমন হতভম্ব অস্থির ভাব। বাবাকে দেখে কিছু বোঝা যায় না, বরং অন্য দিনের তুলনায় একটু যেন উজ্জ্বল। বড় আপা মনে হয় প্লেট-বাটিগুলো ধুতে লেগেছেন। ওর সঙ্গে হাত লাগানো উচিত, কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে না। অন্য দিন হলে মা বকা দিয়ে রান্নাঘরে পাঠাতেন ওকে, আজ কিছুই বললেন না।
চুপচাপ বাবার কাছে গিয়ে বসে রিনি। ঘরের ভেতর রেডিওর মৃদু শব্দকে ছাপিয়ে বাইরের নিস্তব্ধতা যেন সরব হয়ে আছে। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরগুলোও বিমানের আচমকা শব্দে হতবিহ্বল হয়ে ডাকতে ভুলে গেছে। অন্য সময় রাতের এই প্রহরে ওদের থেকে থেকে কান্নার মতো ওদের প্রলম্বিত ডাকে শিউরে ওঠে অন্ধকার। সেই নীরবতা ভেঙে একটা ট্রেন অন্ধকারে সন্তর্পণে গুঁড়ি মেরে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ঘোড়ার খুরের ছন্দে চাকার ধাতব শব্দ কিছু সময়ের জন্য সচকিত করে তোলে অন্ধকারকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বাবা বলেন, ‘এবার লাগবে ভালো করে।’ মা বলেন, ‘লাগার আর বাকি আছে কী? লেগেই তো আছে। ছেলেটা কোথায় কেমন আছে, নিজে থেকে খবর না দিলে জানার উপায়ও নেই।’
বাবা সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে এবার। ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে ইন্ডিয়াকে আক্রমণ করেছে পাকিস্তান। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা আর কাকে বলে।’ রিনি বলে, ‘এই প্লেনগুলো তাহলে কাদের? পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এল নাকি?’ বাবা বলেন, ‘অত দূর থেকে আসতে হবে কেন। তেজগাঁওয়েই তো ওদের স্যাবর জেট আছে কয়েকটা। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে এগুলো ইন্ডিয়ান প্লেন, তেজগাঁও থেকে উড়েছে বলে মনে হচ্ছে না।’ তারপর নব ঘুরিয়ে রেডিওটা বন্ধ করে দিয়ে জানান, ‘ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার একটা জনসভায় স্পিচ দিয়েছেন আজ বিকেলে। তারপরই এই হামলার খবর আসে। তাড়াহুড়া করে দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন এখন। অল ইন্ডিয়া রেডিও বলছে, আজ রাতেই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন রেডিওতে। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।’
অন্য সময় হলে মা এতক্ষণে শুতে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন। আজ কেউ যায় না। বড় আপা ম্লান মুখে এসে বসে মায়ের পাশে। বাবার ঘুরিয়ে চলা রেডিওর নব কোনো স্টেশনে বেশিক্ষণ থাকে না, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও নয়। কিছুক্ষণ পরপর আকাশবাণীতে এসে স্থির হচ্ছেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধী ভাষণটা ঠিক কখন দেবেন বোঝা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর চমৎকার ইংরেজি ভাষণটা শুনে বেশ হতাশই হলেন বাবা, বিড়বিড় করে বলেন, ‘শুধু ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করলেন, স্বীকৃতি দিলেন না!’ ইংরেজিটা ভাষণটা শুনে তাঁর মন ভরে না, হিন্দিটাও শুনলেন পুরোটা।
পরদিন দুপুরের পর আরেকবার ঢাকার আকাশে দেখা দেয় রহস্যময় যুদ্ধবিমান। সাইরেনের আওয়াজকে ডুবিয়ে দিয়ে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া সেই দ্রুতগতি বিমানের পেটের কাছে লাল-সবুজের গোল বৃত্ত দেখে নিশ্চিত হয় সবাই, ওগুলো স্বাধীন বাংলা বাহিনীর প্লেন। ঢাকার আকাশে কোনাকুনি সাদা ধোঁয়ার মোটা রেখা টেনে উড়ে যাওয়ার পরপরই বিস্ফোরণের গম্ভীর শব্দ শোনা যায়। তারপর উত্তর-পশ্চিম আকাশে পাকিয়ে ওঠে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী।
সেদিন থেকে সাইরেনের আওয়াজ কানে যেতেই বড় আপা আর দুলাভাইকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে উঠে যায় রিনি। বাবাও ওঠেন কখনো। আপা ভয়ে ভয়ে যায়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফেরার পর থেকে আপা আগের মতো নেই, সব সময় কেমন যেন আতঙ্কিত ভাব। বাচ্চাকাচ্চা না হলেও নাকি একেক জনের একেক রকম বিকার হয়। মা ভয়ে ওঠেন না, ওদেরও নিরস্ত করার চেষ্টা করেছেন, পারেননি। বোমা পড়ার ভয় উপেক্ষা করে আশপাশের সব ছাদে মানুষের উল্লসিত চিৎকার, হাত নাড়ে কেউ কেউ। রিনির গোপন আনন্দটা আরও একটু বেশি, এ সময় সামান্য দূরের বাড়ির ছাদে অনেকের সঙ্গে উঠে আসে রাজু ভাই। রিনি তখন আর প্লেন দেখে না, দেখে রাজু ভাইকে। ভাইয়ার কাছে আগে প্রায়ই নানান অসিলায় আসত বলে রিনির সঙ্গে আলাপও হয়ে গিয়েছিল। রিনি বুঝতে পারত, আসল উদ্দেশ্য ছিল ওর সঙ্গে দেখা করা, নানা ছুতায় কথা বলার চেষ্টাও করত। এমনিতে খারাপ না রাজু ভাই। পাড়ার ছেলেদের জুটিয়ে নিয়ে ওদের বাসার পাশের মাঠে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করত, একটা চোখ থাকত রিনিদের বাসার দিকে। পাড়ার যেকোনো বিষয়ে যে কারও সমস্যায় সবার আগে রাজু ভাই। রিনি জানে, ওর চেনা মেয়েদের আরও কয়েকজন রাজু ভাইকে পছন্দ করে, তিনি বিশেষ পাত্তা দেন না, নজরটা যেন ওর দিকেই বেশি। ওর চোখ ভুল করে না। তবে ভাইয়া খুব বেশি পছন্দ করেন না রাজু ভাইকে। দু-একবার বলেছেন, ‘ওটা একটা লাফাঙ্গা।’ অথচ দেখা হলে বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই কথাবার্তা বলতেন কয়েক বছরের জুনিয়র ছেলেটার সঙ্গে, পাড়ার কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করতে এলে বুদ্ধি-পরামর্শও দিতেন।
এই তো কয়েক মাস আগে ক্রিকেট ক্লাব করবে, তাই চাঁদা তুলতে কয়েকজনকে নিয়ে এসেছিল বাবার কাছে। পর্দার পেছন থেকে সব শুনেছে রিনি। বাবা একটু বিরক্ত গলায় বলেছিলেন, ‘তোমাদের বয়সী ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ করছে, আর তোমরা ক্রিকেট ক্লাব বানাচ্ছ। ব্যাপারটা কেমন ভেবে দেখেছ একবার?’ ওরা কোনো উচ্চবাচ্য করেনি, মাথা নিচু করে ফিরে গিয়েছিল। পরে বাবাকে বকা দিয়েছিলেন মা, ‘ওদের যে এভাবে বললে, যদি আর্মির কাছে গিয়ে বলে দেয়? তোমার ছেলে যে ঘরছাড়া, অনেকেই তো জানে সেটা।’ বাবা চিন্তিত মুখে বলেন, ‘হ্যাঁ, কথাটা মাথায় আসেনি। মেজাজটা এমন খারাপ হয়ে গেল।’ তারপর থেকে কিছুদিন মুখ শুকনো করে ছিলেন বাবা। তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। রিনি জানে, হয়তো ওর কথা ভেবেই রাজু ভাই বাবার কথাগুলো হজম করে নিয়েছিল।
তবে সেদিন থেকে রাজু ভাইয়ের সাহস খুব বেড়ে গিয়েছিল। এখন কলেজে যায় না রিনি। ঘরের বাইরে যাওয়াই বন্ধ প্রায়। তবু ছাদে উঠলে ইশারায় ওকে নিচে নেমে গেটের বাইরে আসতে বলত। রিনি ভয়ে ভয়ে গেছে। কিন্তু রাজু ভাইয়ের বিশেষ কোনো কথা নেই, আবোলতাবোল কথাবার্তা, বেশির ভাগেরই মাথামুণ্ডু নেই। একবার কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ভাইয়ার কোনো খবর পাওয়া গেছে?’ রিনি ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়েছিল। বাবা যে ওদের বকা দিয়েছিলেন, সেটা মনে পড়ে যায় ওর। তবে রাজু ভাই এ বিষয়ে আর কোনো দিন কিছু বলেনি। কয়েকবার এ রকম আধা গোপন দেখা হওয়ার পর রিনিরও সাহস কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। একদিন সুযোগ পেয়ে বলেই ফেলে, ‘পাড়ার ছেলেদের জুটিয়ে নিয়ে সারা দিনই দেখি দেশোদ্ধার করছেন, মুক্তিযুদ্ধে যাননি কেন?’ রাজু ভাই একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল, তারপর নির্লজ্জের মতো হেসে বলেছিল, ‘যুদ্ধে গেলে যদি মরে যাই, তাহলে তোমাকে তো আর দেখতে পাব না।’ কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল রিনির। পা দুটো কি টলে গিয়েছিল? তবু সামলে নিয়ে বলেছিল, ‘ইশ্! আসলে ভিতুর ডিম আপনি।’ রাজু ভাই ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিল, ‘আমি যুদ্ধে গেলে যদি তুমি খুশি হও, তাহলে একদিন ঠিকই চলে যাব। তখন কান্নাকাটি করতে পারবে না। কিন্তু তোমাকে দেখে রাখবে কে?’ রিনি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেছিল, ‘আহা, শখ কত!’
রিনির কেবলই মনে হতো রাজু ভাই যুদ্ধে গেলে বেশ হতো। চলে যাওয়ার পর কোনো খবর না পেয়ে রাতের বেলা লুকিয়ে কাঁদত ও, মাঠের শেষ মাথায় যে রাস্তাটা পাড়ায় ঢুকেছে, ছাদে উঠে সেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা হু হু করে উঠত। এ রকম কল্পনায় ভেসে যায় রিনি।
তার পরের দিনগুলো অনেকটা স্বপ্নের মতো কেটে যায়। এমন উত্তেজনা আগে কখনো অনুভব করেনি রিনি। গোটা পাড়ার অবস্থা একই রকম। মাঝেমধ্যে ছুটে আসত লাল-সবুজের চিহ্ন আঁকা ফাইটার বিমান। ওগুলোর পেছনে আকাশে ফুটে উঠত কয়েকটা সাদা তুলোর বল। দুলাভাই বলেন, ‘ওগুলো অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গানের গোলা। তেজগাঁও এয়ারপোর্টের রানওয়ের মাঝখানে বোমা পড়ে পুকুরের মতো গর্ত হয়ে গেছে। ওখান থেকে পাকিস্তানি কোনো ফাইটার উড়তে পারবে না। ঢাকার পুরো আকাশ এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে।’
এর মধ্যে ঢিমেতালে উড়ে যাওয়া একটা বিমান থেকে অসংখ্য কাটা ঘুড়ির মতো নেমে আসা কাগজের টুকরোয় ছেয়ে যায় ঢাকার আকাশ। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ করার জন্য ইন্ডিয়ান আর্মির লিফলেট। আকাশবাণী থেকে ক্রমাগত বলা হচ্ছে, ‘হাতিয়ার ডাল দো।’
শোনা যাচ্ছে, ইন্ডিয়ান আর্মি ঢুকে পড়লে ঢাকা রক্ষা করার জন্য পাকিস্তান আর্মি ঘরে ঘরে যুদ্ধ চালাবে। এর মধ্যে গুজব, রাজাকাররা মানুষের বাড়িতে লুটপাট চালাতে পারে। এলাকার ছেলেদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার কথা বলে যাচ্ছে রাজু ভাই। রিনিদের বাড়িতে এসেও বেশ কায়দা করে বলে, ‘চিন্তা করবেন না, আমরাও পাহারায় থাকব।’ তারপর সঙ্গীদের বিদায় করে দিয়ে দুলাভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে। রিনির সঙ্গেও খুনসুটি করে দুলাভাইয়ের সামনেই।
এর মধ্যে শোনা যায়, কারা যেন ইউনিভার্সিটির টিচারদের কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে গেছে, এখনো ফেরেনি ওরা। রাতের বেলায় নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ কখনো দূর থেকে ভেসে আসে গুলির আওয়াজ। রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা প্রায় নেই, সন্ধ্যার পর ভুতুড়ে হয়ে ওঠে পুরো পাড়া।
সেদিন সকাল থেকেই টান টান উত্তেজনায় মহল্লার মানুষ মোড়ে মোড়ে জটলা করে। দুপুরের দিকে কোথা থেকে যেন আচমকা অস্পষ্ট ধ্বনি ভেসে আসে—জয় বাংলা। পাড়ার মানুষ হকচকিয়ে যায়। এত দিনের বন্দিদশার পর অবিশ্বাস্য এই আওয়াজের ওপর আস্থা রাখতেও যেন ভয় পাচ্ছে মানুষ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসে, দলে দলে মানুষ গলা ফাটিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে রাস্তায় নেমে পড়ে। শোনা যায় পাকিস্তানি কনভয় থেকে গুলি হয়েছে, মারাও গেছে কজন।
বিকেলে বাইরে থেকে খবর নিয়ে ফেরেন বাবা, কিছুক্ষণের মধ্যে সারেন্ডার করবে পাকিস্তানি বাহিনী। শুনে মা আবার কাঁদতে বসেন। ছেলেটা কোথায়, বেঁচে ফিরবে তো! বাবা আশ্বস্ত করার জন্য বলেন, ‘আরে দেশের কমিউনিকেশন খারাপ, ব্রিজট্রিজ ভাঙা, ঢাকায় পৌঁছাতে তো সময় লাগবে।’ কিন্তু বাবার কণ্ঠে বিশেষ জোর নেই, যা বলছেন নিজেও বিশ্বাস করছেন না হয়তো।
এ রকম সময় রাজু ভাই কোথায় কে জানে। আজ অনেকবার ছাদে উঠেছে রিনি, এত লোক বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে, কিন্তু সারা দিনের মধ্যে একবারও দেখা যায়নি ওকে, অবাক ব্যাপার। ভাইয়ার জন্য চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে মাঝখানে রাজু ভাইয়ের চিন্তাটা ঢুকে পড়েছে বারবার।
পরদিন সকালে ছাদ থেকে একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় রিনি। কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে রাজু ভাই—‘জয় বাংলা।’ ওদের সবার কাঁধে ঝুলছে রাইফেল, কোথা থেকে জোগাড় করেছে কে জানে!
ফারুক মঈনউদ্দীন: কথাসাহিত্যিক