কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আজ রোববার রাজধানীতে গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। বঙ্গভবনে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্মারকলিপি গ্রহণ করেছেন তাঁর সামরিক সচিব। তিনি এটি দ্রুতই রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছে দেবেন বলে শিক্ষার্থীদের জানিয়েছেন।
আজ বেলা তিনটায় স্মারকলিপি দিয়ে বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে আসেন আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১২ জন প্রতিনিধি। রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া স্মারকলিপিতে বিষয় হিসেবে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করে আইন প্রণয়ন প্রসঙ্গে৷’ নিবেদক হিসেবে লেখা হয়েছে, ‘চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের পক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।’
স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতিকে বলা হয়েছে, আপনি অবগত আছেন, ২০১৮ সালে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের গণ–আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরি (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) থেকে কোটাপদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে জাতীয় সংসদে কোটা বিলুপ্তির ঘোষণা দেন। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি চাকরি থেকে কোটাপদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের ঘোষণা দিয়ে পরিপত্র জারি করা হয়। কোটা সংস্কার ছিল শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রাণের দাবি। বৈষম্যমুক্ত ও মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণে চাকরিতে কোটাপদ্ধতির পুনর্বিবেচনা করে কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। সরকার সার্বিক বিবেচনায় নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেডে কোটার বিলুপ্তিকে সমাধান মনে করেছিল।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের এই পরিপত্র জারি হওয়ার পর কোটামুক্তভাবে কয়েকটি সরকারি চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ওই পরিপত্র সংবিধানের আলোকে ত্রুটিযুক্ত ছিল। ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর মহামান্য হাইকোর্ট একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন এবং গত ৫ জুন এই রুলকে অ্যাবসলিউট হিসেবে রায় দেন আদালত। রায়ে এই পরিপত্রকে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেন। এর ফলে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের চাকরির নিয়োগে কোটা পুনর্বহাল হয়। পরে ১০ জুলাই সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটাপদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগ৷ ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায়ের কিছু অংশ ১১ জুলাই প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারবে।
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়েছে, আমরা মনে করি, ২০১৮ সালের পরিপত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। কেননা, শিক্ষার্থীরা সব গ্রেডের সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিল। প্রথমত, কোটার অসহনীয় মাত্রা মানে দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর দাবি ও আন্দোলনের সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রহসন। মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, তা নিশ্চিত করতে ও একটি দক্ষ প্রশাসন গড়তে মেধাভিত্তিক নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, কোটাপদ্ধতি না থাকলে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ থেকে বঞ্চিত হবে। তৃতীয়ত, ২০১৮ সালের পরিপত্রটি শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারির চাকরির জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে ৫ শতাংশ কোটাকে ছাত্রসমাজ যৌক্তিক মনে করে। তাই আমাদের দাবি হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য কোটাকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে (সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ) এনে সংসদে আইন পাস করে কোটাপদ্ধতিকে সংস্কার করতে হবে৷
স্মারকলিপিতে রাষ্ট্রপতিকে আরও বলা হয়, মহামান্য, ছাত্রসমাজের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আপনার কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করে বাধিত করবেন। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারবে। ছাত্রসমাজ দীর্ঘদিন ধরে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে রাজপথে ঝড়-বৃষ্টি-খরতাপ উপেক্ষা করে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমাদের কারণে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হোক, তা আমরা কখনোই চাই না। আমরা দ্রুতই পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে চাই। ছাত্রসমাজ আশা রাখে, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করতে উদ্যোগ নিয়ে বাধিত করবেন। অন্যথায় ছাত্রসমাজ নিজেদের অধিকার রক্ষায় এবং বৈষম্যমুক্ত ও মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণে সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হবে।
বঙ্গভবনে স্মারকলিপি দিতে যে ১২ জন গিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ, মো. মাহিন, আবদুল কাদের ও আবদুল হান্নান মাসউদ, সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম ও রিফাত রশিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেল, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আশিক আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক মেহেরুন্নেসা নিদ্রা এবং ইডেন মহিলা কলেজের সমম্বয়ক সুমাইয়া আখতার।