জলের গান, ইলিশের স্বাদ, তুরাগে নৌভ্রমণের স্মৃতি নিয়ে গেলেন মাখোঁ
রাষ্ট্রীয় নানা কর্তব্য সেরে গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ছেড়েছেন এমানুয়েল মাখোঁ; কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের প্রাণস্পন্দন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসেছিলেন রাষ্ট্রীয় নিমন্ত্রণে। বাণিজ্য সম্পর্কসহ দুই দেশের আরও প্রসঙ্গ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে, সেটিই তো স্বাভাবিক। তবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ রাষ্ট্রীয় কর্তব্যকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন আরও অনেক দূর। বাংলাদেশে নেমেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন বাংলাদেশের প্রাণের স্পর্শ পাওয়ার প্রত্যাশায়। গ্রহণ করতে চাইলেন এর শিল্পের স্বাদ, পেতে চাইলেন এর প্রকৃতির ঘ্রাণ, সহজভাবে মিশে গেলেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে।
বিশ্বজুড়ে ফ্রান্সের সুনাম সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। বাংলাদেশে এমানুয়েল মাখোঁর সফরপঞ্জি ভরে রইল প্রাণভরে এ দেশের প্রকৃতি আর সংস্কৃতির উপাদানে। মাখোঁ নিজেও সংগীতের অনুরাগী। নিজে শৌখিন পিয়ানোবাদক। শখের বশে গানও করেন। এ বছরের এপ্রিলে প্যারিসের রাস্তায় গান গাইতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। পরে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এমানুয়েল মাখোঁ গতকাল বেড়াতে গিয়েছিলেন তুরাগ নদের তীরে। নদের পাড়ঘেঁষে বসেছে সস্তা সমুচা–শিঙাড়ার দোকান। মাখোঁ হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলেন দোকানির সঙ্গে। পরিবেশ দেখে দোকানি ততক্ষণে বুঝে গেছেন, তিনি যে–সে ক্রেতা নন। ক্রেতার চেয়েও বেশি অতিথি। মাখোঁর হাসি ছড়িয়ে পড়ল তাঁর মুখেও। বিশিষ্ট অতিথিকে আপ্যায়নের জন্য দুটি জিলাপি আর একটি করে সমুচা ও শিঙাড়া এগিয়ে দিলেন দোকানি। দুই হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানালেন মাখোঁ। সমুচাটি নিয়ে বললেন, এটি নিয়ে তিনি বিমানে উঠবেন।
দোকানের পাশে মিরপুর বড়বাজার ইকোপার্ক। তার ঘাটে মাখোঁর জন্য বাঁধা ছিল একটা পানসিনৌকা। ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে নেমে পানসিতে ওঠার পথে কথা জমে উঠল তাঁর মাঝিদের সঙ্গে। হাত মেলালেন কারও কারও সঙ্গে। কেউ কেউ তাঁর সঙ্গে তুললেন ছবি।
দুপুর ১২টার দিকে পানসিতে চড়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়লেন বাংলার জলপথে। পানসি চলেছে সাভারের কাউন্দিয়ার দিকে। তখন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে। মৃদু বৃষ্টির মধ্যেই শুরু হলো নৌকাবাইচ। আনন্দ নিয়ে তা উপভোগ করলেন মাখোঁ। তাঁর সম্মানে এর আয়োজন করেছিল ঢাকার ফ্রান্স দূতাবাস ও সামাজিক সংস্থা ‘ফ্রেন্ডশিপ’।
২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের এক সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। রোববার রাত ৮টা ১০ মিনিটে ঢাকায় নেমেছিলেন তিনি। রোববার রাতেই তাঁর সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্যুপ, রুটি–মাখনের সঙ্গে তাঁকে ইলিশ, কাচ্চি বিরিয়ানি, কাবাব, লুচি, পিঁয়াজু, সমুচা ইত্যাদি দেশি পদের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। খাওয়ার পরে মিষ্টান্ন হিসেবে পরিবেশন করা হয় পাটিসাপটা পিঠা, রসগোল্লা আর মিষ্টি দই। নৈশভোজের আগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে পরিবেশন করা হয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্য।
নৈশভোজ শেষে রাতে এমানুয়েল মাখোঁ গিয়েছিলেন ‘জলের গান’–এর শিল্পী রাহুল আনন্দের ধানমন্ডির বাসায়। গিয়েছিলেন ৪০ মিনিটের জন্য; কিন্তু গানে আর আড্ডায় পার হয়ে যায় ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। রাহুল তাঁকে গেয়ে শোনান বাংলার মাটি থেকে উৎসারিত গান। লালন থেকে আব্বাসউদ্দীন আহমদ, আবদুল আলীম থেকে প্রতুল মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত চলে সেই গানের পালা। ‘নাইয়ারে, নায়ের বাদাম তুইলা’ থেকে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ অবধি নানা স্বাদের গান তিনি গেয়ে শোনান। রং–চায়ে চুমুক দিতে দিতে সেসব উপভোগ করেন মাখোঁ।
রাহুল আনন্দের স্টুডিওর দেয়ালজুড়ে সাজানো দেশি বাদ্যযন্ত্র। কিছু তাঁর নিজ হাতে তৈরি—দ্রৌপদী, পাগলা, পদ্মা, মনদোলা, তোতাবান আর চন্দ্রবান। সেই সংগ্রহভান্ডার থেকে মাখোঁকে একটি একতারা উপহার দেন তিনি। একতারা বাজানোর কলাও শিখিয়ে দেন তাঁকে।
ফ্রান্সের এমানুয়েল মাখোঁর প্রশাসন সংস্কৃতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কোনো দেশে সফরে গেলে মানুষ, শিল্প আর প্রকৃতির সংস্পর্শ নেওয়াকে সে দেশ বোঝার অপরিহার্য অংশ বলে মনে করেন তাঁরা। ২০১৮ সালে ভারত সফরেও চিত্রশিল্পী সুবোধ গুপ্তের স্টুডিওতে গিয়েছিলেন মাখোঁ। সে বছর নাইজেরিয়া সফরের সময় গিয়েছিলেন সেখানকার কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ফেলা কুটির ক্লাবে। গত এপ্রিলে চীনে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে যোগ দেন মাখোঁ।