পোড়া দেহ নিয়ে ধুঁকছেন তাঁরা, স্বজনদের দুশ্চিন্তা টাকা নিয়ে

রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে দগ্ধ বাবলু বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীনছবি: মানসুরা হোসাইন

কাজ শেষে মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন বাচ্চু মিয়া। তারপর বিস্ফোরণে পরনের কাপড়, টাকা, ব্যাগ, জুতা—সব কোথায় উড়ে যায়, তা বলতেও পারেন না। পাশের এক ছেলেকে জাপটে ধরে শুধু বলেছিলেন, ‘বাজান, আমারে বাঁচাও।’ এরপর ওই ছেলে কোথা থেকে এক ভ্যানগাড়িতে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। ওই ভ্যানে এক নারীর লাশও ছিল।

এভাবেই ছোট এক জুতার দোকানের শ্রমিক বাচ্চু মিয়া বলছিলেন, ৭ মার্চ বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে গুলিস্তানের বিআরটিসির বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিক বাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেট নামে পরিচিত সাততলা ভবনে বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কথা। জানালেন, তিনি ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন, তখনই ঘটে বিস্ফোরণের ঘটনা। ওই ঘটনায় ২৫ শতাংশ পোড়া নিয়ে বাচ্চু মিয়া শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।

বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবনটির বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। দুই পাশ লাগোয়া দুটি ভবনের কিছু অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনার পর তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছিল, ভবনে থাকা তিতাস গ্যাসের সংযোগ ছিদ্র হয়ে জমা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

হাসপাতালে বাচ্চু মিয়ার সামনের বিছানাতেই ভর্তি আছেন ২৪ বছর বয়সী বাবলু। তাঁর শরীরের ২০ শতাংশ পুড়েছে। তিনিও একটি জুতার দোকানে কাজ করতেন। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন। তখনই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বাচ্চু মিয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে পারলেও বাবলু জানালেন, বিস্ফোরণের পর তাঁর আর কিছুই মনে নেই। হাসপাতালে তাঁকে কে ভর্তি করেছে, তা–ও জানেন না।

আজ মঙ্গলবার হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় বাচ্চু মিয়া ও বাবলুর সঙ্গে। জানালেন চিকিৎসা খরচের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা। এই দুজনের পাশে থাকা স্বজনেরা বারবার জানতে চাচ্ছিলেন, প্রতিবেদক যে তথ্য লিখে নিচ্ছেন, তা ছাপা হলে তাঁরা কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাবেন কি না। জানালেন, দুর্ঘটনার পর তাঁরা ১৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। তবে স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না এই সহায়তা কে দিয়েছে। ঘটনার পর ঢাকার জেলা প্রশাসক আহত ব্যক্তিদের এই সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বাচ্চু মিয়ার বড় ছেলে আরেকটি জুতার দোকানের শ্রমিক মো. সোহাগ মিয়া বললেন, ১৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তার মধ্যে রক্তের ক্রস ম্যাচিং করতে এবং অন্যান্য খরচ বাবদ আট হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। দিনে দুইটা করে ইনজেকশন কিনতে হচ্ছে, একেকটার দাম এক হাজার টাকা। তাঁর বাবা কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, তা–ও জানা নেই। বাবার পায়ে নতুন করে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। সামনে ঈদ। ঈদ হাসপাতালেই করতে হয় কি না, সে চিন্তাও করতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন বাচ্চু মিয়ার পাশে আছেন স্ত্রী ও ছেলে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

বাচ্চু মিয়ার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থানায়। ঘটনার পর থেকে স্ত্রী রোকেয়া বেগম হাসপাতালেই আছেন। এই দম্পতির এক ছেলে মাদ্রাসায় পড়ছে। ১৬ বছর বয়সী আরেক ছেলে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। গ্রামের বাড়িতে খুব বেশি হলে ২ শতাংশ জমি আছে। বাচ্চু মিয়া পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার কবে কাজে ফিরতে পারবেন, সে চিন্তায় আছেন পরিবারের সদস্যরা।

দুর্ঘটনার পর পরিচিত দুজনের কাছে বাবলুর মা কুলসুম বেগম খবরটি জানতে পেরেছিলেন। এরপর থেকে তিনি ও তাঁর স্বামী কৃষক ইসমাইল মিয়া লক্ষ্মীপুর থেকে এসে ছেলের পাশে হাসপাতালেই আছেন। বাবলু ছাড়াও এ দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে।

বাবলুর বাঁ হাতে পুরোটা ব্যান্ডেজ করা। বিস্ফোরণে হাতে ভাঙা কাচের টুকরা ঢুকেছে। এ ছাড়া মুখসহ সারা শরীর পুড়েছে। আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন বাবলু।

বাবলুর মা কুলসুম বেগম জানালেন, ঋণ করে ছেলের চিকিৎসার খরচ সামলাচ্ছেন। এ পর্যন্ত কত খরচ হয়েছে তার হিসাব সেভাবে রাখা হয়নি।

বাচ্চু মিয়া ও বাবলু হাসপাতালের চিকিৎসক এবং নার্সদের ব্যবহার ও চিকিৎসায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। তবে বললেন, চিকিৎসকদের আচরণ ভালো হলে তো লাভ নেই, অনেক ওষুধ হাসপাতালে নেই, তাই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী রেজিস্ট্রার (অরেঞ্জ ইউনিট) নূরে আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাচ্চু মিয়া ও বাবলুর শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। কম সময়ের মধ্যেই তাঁদের হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে।

সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ মো. হাসান (৩২) নামের একজন ২৬ মার্চ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা গেছেন। তাঁকে নিয়ে এ ঘটনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের।