দিন দিন চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে মানুষ আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ছেন।
চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয়ের অংশ বছর বছর কমছে। বিপরীতে ব্যক্তির পকেটের খরচ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের তিন–চতুর্থাংশ বহন করছেন ব্যক্তি নিজেই।
বছর বছর মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের ভাগ কমে আসার এবং ব্যক্তির ভাগ বেড়ে যাওয়ার পরিসংখ্যান দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। তাদের পরিসংখ্যান বলছে ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে। আবার ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা করাতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে। তবে এই ধারা শুধু তিন বছরের নয়। এই প্রবণতা দুই দশকের বেশি সময়ের।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭–২০২০’ প্রতিবেদনে ব্যয়ের এই হিসাব দিয়েছে। এখানে করোনাবিষয়ক খরচ যুক্ত করা হয়নি। ৯৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের তথ্য–উপাত্ত গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত কর্মশালায় প্রকাশ করা হয়। এর আগে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন ও ব্যয়ের হিসাব নিয়ে এই ধরনের পাঁচটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
কর্মশালায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি, জনস্বাস্থ্যবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচক হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা বলেন, মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৯ শতাংশ ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় হলে তা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের পথে অন্তরায়। অন্যদিকে মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ইউনিসেফ ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মায়া ভ্যানডেনেন্ট বলেন, ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেশি হওয়ার অর্থ অনেকের জন্য তা বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়। এই ব্যয়ের কারণে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।
গত বছরের শেষ দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ২৪ শতাংশ মানুষ বিপর্যয়মূলক ব্যয়ের মধ্যে পড়ছেন, চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতিবছর ৬২ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন এবং ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ১৬ শতাংশ খানা চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকে।
কে, কত ব্যয় করছে
অনুষ্ঠানে বলা হয়, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় বাড়ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাথাপিছু বার্ষিক স্বাস্থ্য ব্যয় ৫৪ মার্কিন ডলার। ১ ডলার ৮৪.৭৭ টাকা হিসাবে যা ৪ হাজার ৫৭৮ টাকা। ২০১৭ সালে তা ছিল ৩৭ মার্কিন ডলার এবং ২০১৪ সালে ছিল ৩৩ ডলার। বর্তমানে ব্যয় বাড়লেও তা শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপের চেয়ে কম।
প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে স্বাস্থ্য খাতে দেশে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭৭ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ব্যক্তি বা খানার ব্যয় ছিল ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ, সরকারের ছিল ২৩ দশমিক ১ শতাংশ, উন্নয়ন সহযোগীদের ব্যয়ের পরিমাণ ৫ শতাংশ। বাকি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর।
প্রতিবেদনে ১৯৯৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে সরকারের অংশের ব্যয় ক্রমান্বয়ে কমছে এবং ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।
স্বাস্থ্য খাতে সরকার যে ব্যয় করে, তার ৯৩ শতাংশ আসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে আসে ১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং বাকি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ আসে অন্যান৵ মন্ত্রণালয় থেকে।
অনুষ্ঠানে অর্থায়ন ও ব্যয়ের তথ্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ হেলথ অ্যাকাউন্টস সেলের ফোকাল পারসন সুব্রত পাল। তিনি বলেন, ব্যক্তির পকেট থেকে যে খরচ হয়, তার ৫৪ শতাংশ খরচ করেন সমাজের সবচেয়ে ধনীরা। সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণি খরচ করে ৪ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এমনও হতে পারে যে দরিদ্ররা সেবা কম গ্রহণ করে। তবে এটা বলা ঠিক হবে না যে তাদের সেবা কম দেওয়া হয়।
ওষুধে খরচ বেশি
চিকিৎসা করাতে গিয়ে ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে কোথায় কত খরচ করেন, তারও একটি হিসাব পাওয়া যায় এই প্রতিবেদনে। তাতে দেখা যায়, মানুষ সবচেয়ে বেশি খরচ করেন ওষুধের পেছনে। ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থ চলে যায় এই খাতে। বাকি অর্থ ব্যয় হয় রোগনির্ণয় বা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা, চিকিৎসক দেখাতে, হাসপাতালে ভর্তি এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সেবা নিতে।
গতকালের অনুষ্ঠানে ওষুধ খাতে ব্যয়ের বিষয় নিয়ে একাধিক বক্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ক্যানসার, কিডনি রোগ বা পক্ষাঘাতের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেকে শেষ সম্বল ভিটা বা জমি বিক্রি করেন। এসব রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেকে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো আগ্রাসী বিপণন নীতি পরিহার করলে, দামি মোড়ক ব্যবহার না করলে, উপহার দেওয়া বন্ধ করলে ওষুধের দাম কমবে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা বলেন, এ খাতে ব্যয় কমাতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সহজ প্রাপ্য করা জরুরি।
ব্যয়ে পার্থক্য
মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৩৭ শতাংশ চলে যায় ঢাকা বিভাগে। সেদিক দিয়ে ঢাকা বিভাগ শীর্ষে। এর পরে চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪ এবং রাজশাহী বিভাগে ১০ শতাংশ ব্যয় হয়। খুলনা ও সিলেট বিভাগে ব্যয় হয় যথাক্রমে ৯ ও ৭ শতাংশ। বরিশাল ও রংপুর বিভাগে ৫ শতাংশ করে ব্যয় হয়। সবচেয়ে কম ব্যয় হয় ময়মনসিংহ বিভাগে—৩ শতাংশ।
দেশের মানুষের মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ৪ হাজার ৫৭৮ টাকা। তবে সব বিভাগের মাথাপিছু ব্যয় সমান নয়। ময়মনসিংহ বিভাগের মানুষের বছরে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ২ হাজার ৬০ টাকা। অন্যদিকে ঢাকা বিভাগের মানুষের মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ৭ হাজার ৩৯ টাকা। এই পার্থক্যের কোনো ব্যাখ্যা গতকালের অনুষ্ঠানে দেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্যে বর্তমান ব্যয় পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠানে বলা হয়, সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। ওষুধের দাম কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার যে বরাদ্দ দেয়, তার সুষ্ঠু ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যের কাজে সরকারের নজরদারি ও তদারকি বাড়াতে হবে।