'১০ জন মিলে কুপিয়ে আমার হাতটা কেটে দিল'
বিছানার দিকে তাকিয়ে প্রথম দেখায় যে–কারওই মনে হবে, তিনি বোধ হয় বেঁচে নেই। দুই পায়ের পুরোটাই ব্যান্ডেজ। বাঁ হাতের অর্ধেক নেই। কনুইয়ের ওপরের অবশিষ্টাংশও মোড়ানো ব্যান্ডেজে। মুখের বাঁ পাশে গাল থেকে চোখের নিচে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। আর বাঁ চোখের ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধা।
কাছে গেলে ভুল ভাঙে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ২১৭ নম্বর কেবিনের বিছানায় এভাবে পড়ে থাকা ব্যক্তিটি হলেন ইলিয়াস নোমান। ময়মনসিংহ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য। পেশায় ঠিকাদার। তবে রাজনীতি তাঁর জীবনকে কালো ছায়ায় ঢেকে দিয়েছে। প্রতিপক্ষের ১০ জন যুবকের এলোপাতাড়ি কোপে নোমান এখন পঙ্গু।
কী অপরাধ ছিল—গতকাল মঙ্গলবার রাতে পঙ্গু হাসপাতালে এমন প্রশ্ন করতেই নোমান বললেন, ‘ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের যশোরা ইউনিয়নের যশোরা গ্রামে আমার বাড়ি। আমার গ্রামের পাশে খোদাবক্সপুর গ্রামের অর্ধেক এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ায় কথা বলে আমার গ্রামের কয়েকজন যুবক খোদাবক্সপুর গ্রামের প্রায় ৩০টি পরিবারের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নেয় বছরখানেক আগে। কিন্তু বিদ্যুৎ–সংযোগ আসেনি। পরে গ্রামবাসী নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে বিদ্যুৎ–সংযোগের ব্যবস্থা করেন। আমি তাঁদের সহায়তা করছিলাম। এটাই আমার কাল হলো।’
ইলিয়াস নোমান বলেন, ‘২ সেপ্টেম্বর সকালে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন আসে। তাদের সঙ্গে পুলিশ আসে খোদাবক্সপুর গ্রামে। আমি তখন সেখানে ছিলাম না। কিন্তু বিদ্যুৎ–সংযোগ দিতে গেলে যারা আগে টাকা নিয়েছিল, তারা বাধা দেয়। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনদের ঘিরে ফেলে। পরে পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়। ওদের ধারণা, আমি এই কাজ করিয়েছি। পরে বিকেলে আমার ওপর হামলা করে।’
যশোরা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সুমনের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয় বলে দাবি নোমানের। তিনি বলেন, ‘বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে শিবগঞ্জ বাজার থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। শহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির বাড়ির সামনের বাঁশঝাড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাকিব, আকিব, সুমন, ওয়াহিদ, ফয়সাল, মাহফুজসহ ১০ জন আমার মোটরসাইকেলের ওপর ঢিল ছুড়তে থাকে। আমি পড়ে গেলে ওরা চাপাতি, রামদা, পাইপ, রড হাতে নিয়ে প্রথমে আমার মাথায় আঘাত করে। চাপাতির কোপ মাথায় না লেগে মুখে লাগে। “শালারে জানে মার” বলে দুই পা-হাতে এলোপাতাড়ি কোপ দেয়। সুমন, মাহফুজ ও ওলাদ রামদা দিয়ে বাঁ হাতে কোপ দেয়। আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকি।’
আহত নোমানকে প্রথমে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে আনা হয়। ওই রাতেই অস্ত্রোপচার করে নোমানের বাঁ হাতটি ফেলে দিতে হয়। তবে রক্তক্ষরণ কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছিল না। তাই পাঁচ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয় তাঁকে।
পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেন, হাতের কাটা অংশ থেকে নোমানের শরীরে সংক্রমণ ছাড়ানোর ঝুঁকি আছে। তাই নোমানের সুস্থ হতে আরও দীর্ঘ সময় লাগবে।
নোমানের ভাষ্য, ‘বিদ্যুৎ–সংযোগ নিয়ে এত কিছু করলাম। আমি সুস্থ থাকা অবস্থায় খোদাবক্সপুর গ্রামে বিদ্যুৎ–সংযোগ আসেনি। কিন্তু যেদিন আমার হাত কাটা পড়ল, তার পরের দিন ওই গ্রামে বিদ্যুৎ–সংযোগ এল।’
২৯ বছর বয়সী নোমান বলেন, ‘১০ দিন হয়ে গেল। মামলা করল আমার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার। কিন্তু একজন আসামিও ধরা পড়ল না। মানুষের ঘরে আলো জ্বালাতে গিয়ে আমাদের জীবনের আলো নিভে গেল। কাটা হাত নিয়ে বাকি জীবন কী করব?’ নিজের চার বছর বয়সী মেয়ের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন, ‘সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে, আমার ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে আর ঘুরতে পারব না, কোলে নিতে পারব না। জীবনে এটাই আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট।’
এ মামলার তদন্ত করছেন গফরগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আহসান হাবিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘটনায় ১০ জন আসামির নাম উল্লেখ আছে। তার মধ্যে ৯ জনই পলাতক। এজাহারভুক্ত এক আসামি সারোয়ার জাহান ওরফে ধনুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি মামলার ৭ নম্বর আসামি। কারা এই হামলার সঙ্গে জড়িত—জানতে চাইলে এই এসআই বলেন, ইলিয়াস নোমান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। হামলা যাঁরা করেছেন, তাঁরাও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অন্তর্দলীয় কোন্দলে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে পুলিশ মনে করছে। অন্য আসামিদের ধরতে গতকাল রাতেও বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। ইলিয়াস নোমানের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ নেই।
তবে ইলিয়াস নোমানের দাবি, আসামিরা এলাকাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, ইলিয়াস নোমান প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিলের চাচাতো বোনের ছেলে।