'এখানে যত নিয়োগ, তত দুর্নীতি'

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে (ইফা) গত ১০ বছরে প্রায় ২ হাজার ৮০০ নিয়োগ হয়েছে। এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে মহাপরিচালকের (ডিজি) শ্যালিকা, ভাতিজা, ভাগনে–ভাগনিসহ ১০ জন নিকটাত্মীয় নিয়োগ পেয়েছেন।

সর্বশেষ রাজস্ব খাতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৯টি গুরুত্বপূর্ণ পদে যে নিয়োগ হয়, তাতেও মহাপরিচালকের নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজন রয়েছেন। তাঁদের নিয়োগ দিতে পরীক্ষার নম্বর পরিবর্তন এবং প্রার্থীদের কোটা পরিবর্তন করাসহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে তদন্তের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় গত বুধবার অতিরিক্ত সচিব মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করেছে। ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, ফাউন্ডেশনের একটি প্রকল্পে অস্থায়ী ভিত্তিতে চার বছর চাকরি করতেন নাসির উদ্দিন শেখ। তিনি প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নাসির শেখ অভিযোগ করেন, তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, কিন্তু জালিয়াতি করে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাঁর এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল ২০০৯ সালে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১০ জন নিকটাত্মীয়কে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন। এর মধ্যে তাঁর শ্যালিকা ফারজীমা মিজানকে আর্টিস্ট পদে, ভাগনি ফাহমিদা বেগম সহকারী পরিচালক, সিরাজুম মুনীরাকে মহিলা কো-অর্ডিনেটর, ভা​গনে এহসানুল হক বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম এবং ভাতিজা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মোস্তাফিজুর রহমান সহকারী পরিচালক পদে, মো. রেযোয়ানুল আলম প্রকাশনা কর্মকর্তা, মিসবাহউদ্দিন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, শাহ আলমকে উৎ​পাদন ব্যবস্থাপক ও মুনিম এলডিএ পদে এবং মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত হারুনুর রশীদের ছেলে মো. নাজমুস সাকিব সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে নিয়োগ পান।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানকালে সামীম আফজালের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আত্মীয়স্বজন দু–একজন থাকলেও থাকতে পারে। আত্মীয় হলে দোষ কী, তারা কি বাংলাদেশের নাগরিক না?’

নিয়োগ পরীক্ষার ফলে কারসাজি

ইফা সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের এপ্রিল ও আগস্টে ১০টি ক্যাটাগরির ১১টি পদে দুই দফায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে সম্প্রতি সহকারী লাইব্রেরিয়ান, সেকশন অফিসার, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, মহিলা সাংগঠনিক কর্মকর্তা, প্রকাশনা কর্মকর্তা, আর্টিস্ট ও ভাষা শিক্ষক, গবেষণা সহকারী, প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ হয়। এটি রাজস্ব খাতে ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ নিয়োগ। এসব নিয়োগ দিতে পরীক্ষার নম্বরপত্র পরিবর্তন এবং জেলা কোটা, মেধা কোটা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটার পদের যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়ার অভিযোগ আছে।

এর মধ্যে আর্টিস্ট পদে চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি চাওয়া হয়। কিন্তু ফারজীমা মিজানের চারুকলার সনদ নেই। নিয়োগ পরীক্ষার নম্বরপত্রে দেখা যায়, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা মিলে ফারজীমা পান ৬২ নম্বর। সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে নাজমুস সাকিব ৬৮ ও প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে রেযোয়ানুল ৬২ দশমিক ৫ নম্বর পান। পরে তাঁদের প্রাপ্ত নম্বর পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত নম্বরপত্রে রেযোয়ানুলের নম্বর বাড়িয়ে ৬৬ দশমিক ৫ ও ফারজীমার নম্বর বাড়িয়ে ৬৪ এবং নাজমুস সাকিবের নম্বর কমিয়ে ৬১ করা হয়।

>

বর্তমান ডিজির আমলে রাজস্ব খাতে ৭৫, দৈনিকভিত্তিক ৫০০,১৪০ ফিল্ড সুপারভাইজার ও অফিসার, ৬৪ কম্পিউটার অপারেটর, ২০২০ শিক্ষক নিয়োগ হয়। নিয়োগ পেয়েছেন ডিজির শ্যালিকা, ভাতিজা, ভাগনেসহ ১০ আত্মীয়।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লোগো
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লোগো



ইফা সূত্র জানায়, ফারজীমাকে প্রথমে ‘টেকনিক্যাল কোটায়’, পরে মহিলা কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। টেকনিক্যাল কোটা নামে ফাউন্ডেশনে কোনো কোটা নেই। রেযোয়ানুলের নম্বর বাড়ানো হয় মেধা কোটায় নিয়োগ দিতে। আর নাজমুস সাকিবের নম্বর কমানো হয় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগের জন্য। যদিও নম্বরপত্র অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়ার কথা ৫২ দশমিক ৫ নম্বর পাওয়া নাসির উদ্দিন শেখ। মহিলা সাংগঠনিক কর্মকর্তা পদে সর্বোচ্চ ৬৪ নম্বর পান তাসলিমা সারমিন। পরে তাঁর নম্বর কমিয়ে ৬৩ করা হয় মহিলা কোটা থেকে সরিয়ে জেলা কোটায় নিয়োগ দিতে। দ্বিতীয় শ্রেণির প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে মো. ইব্রাহিম হোসেন নিয়োগ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর ৫৮ পান। তাঁকে মেধা কোটা থেকে সরিয়ে জেলা কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের ভাতিজা মিসবাহউদ্দিনের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তিনি ঢাকা জেলা কোটায় নিয়োগ পেতে নিজ জেলা ঢাকা উল্লেখ করেন। একইভাবে নোয়াখালীর নাজমুস সাকিবও জেলা ঢাকা উল্লেখ করেন।

এসব অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়ে ইতিপূর্বে সামীম আফজালের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি বলেন, ‘এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৬ সালে। এত দিন আগে কী হয়েছে, এখন কি আমার মনে আছে?’ তবে নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব ও ফাউন্ডেশনের সাবেক সচিব মো. আলফাজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়োগ নিয়ে যা হয়েছে, তা সবাই জানে। সদস্যসচিব নিয়োগের কাগজপত্র তৈরি করেন। অথচ আমাকে বাদ দিয়েই নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। যে কারণে আমি স্বাক্ষর করিনি।’

ঝুলে আছে ৩০৩০ নিয়োগ

গণশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ১ হাজার ১০টি ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় ৫ হাজার ৫০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ২ হাজার ২০ জনের নিয়োগ হয়েছে। আরও ৩ হাজার ৩০ জন শিক্ষক নিয়োগে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু প্রকল্পেরপরিচালকেরা নিয়োগ নিয়ে মহাপরিচালকের সঙ্গে একমত না হওয়ায় নিয়োগ আটকে আছে।

নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক এবং মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের সাবেক পরিচালক জুবায়ের আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাপরিচালক ৪৭ জনের একটি তালিকা বললেন যে পরীক্ষা ছাড়াই তাঁদের নিয়োগ দিতে হবে। তা মানা সম্ভব ছিল না। তাই পরীক্ষার ফল ঘোষণা করিনি।’ তিনি বলেন, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখানে যত নিয়োগ, তত দুর্নীতি।’