'আতিয়া মহল' অভিযান ঘিরে যা হলো...
সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’ ঘিরে অভিযান চলাকালে সন্ধ্যা ও রাতে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণে পুলিশসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
রাত ১০টার দিকে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক দেবপদ রায় প্রথম আলোকে জানান, তাদের হাসপাতালে তিনজনের মরদেহ আছে। এর মধ্যে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও দুজন বেসামরিক নাগরিক।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। একজন হলেন সিলেট মহানগর পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু ফয়সাল। আরেকজনের নাম ওয়াহিদুল ইসলাম অপু (২৬)। তাঁর বাড়ি চাঁদনীঘাটে। তিনি মদনমোহন কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বলে জানিয়েছেন তাঁর বন্ধু জয়শর্মা চৌধুরী। বন্ধুর ভাষ্য, দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ওয়াহিদুল সবার বড়। আহতদের মধ্যে পুলিশসহ অন্তত ৪০ জন সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছে। এর মধ্যে শিরিন মিয়া, জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও দক্ষিণ সুরমা থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জনি লাল দের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে একটি মোটর সাইকেলে করে দুই যুবক ব্রিফিংস্থলের কাছাকাছি পৌঁছান। তখন বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে দুই যুবক ছিটকে পড়েন। এরপর আরেকটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যুবকদের সঙ্গে রাখা ব্যাগে বোমা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এবং পুলিশ ও সোয়াটের সহায়তায় চলা ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নিয়ে আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা হয়। ব্রিফিং শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পর সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে ব্রিফিংস্থলের কাছে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় সাংবাদিকসহ ৩০ জনের বেশি আহত হন। এরপর রাত সাতটা ৫৫ মিনিটের দিকে আগের ঘটনাস্থলের কাছে পূর্ব পাঠানতলা মসজিদ এলাকায় আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ হয়। ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় ছয় পুলিশ সদস্যসহ আরও কয়েকজন আহত হন।
সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’
শিববাড়ি এলাকায় একই মালিকের ‘আতিয়া মহল’ ও ‘আতিয়া মহল ২’ নামে দুটি ভবন আছে। আতিয়া মহল নামের পাঁচতলা বাড়িটির ২৯টি ফ্ল্যাটের মধ্যে নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা অবস্থান করছে-এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে পুলিশ বাড়িটি ঘেরাও করে। পুলিশের ধারণা, সেখানে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাইনুল ওরফে মুসা রয়েছেন। গতকাল শুক্রবার দিনভর বারবার মাইকে আহ্বান জানিয়েও ভেতরে থাকা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করাতে পারেনি পুলিশ। উল্টো ভেতর থেকে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। অভিযান চালাতে ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটের একটি দল গতকাল বিকেলে সিলেটে পৌঁছায়। রাতভর বাড়িটি ঘিরে রাখা হয়। গতকাল সন্ধ্যার পর সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ি ঘটনাস্থলে যায়।
অভিযানের প্রস্তুতি শুরু
আজ সকাল আটটার দিকে ঘটনাস্থলে অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ফোর্স। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পুলিশের সাঁজোয়া যান ও কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় চালানো অভিযানেও অংশ নিয়েছিল সিলেটের জালালাবাদ থেকে যাওয়া সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল।
জালালাবাদ সেনানিবাসের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের কর্মকর্তা সকাল সাড়ে নয়টার একটু পরই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামে অভিযান শুরুর কথা জানিয়েছিলেন। ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ারুল মোমেন অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
সকাল ১০টা ৫ মিনিটের দিকে পরপর দুটি গুলির শব্দ শোনা গেছে। এলাকার বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। অভিযান শুরু হওয়ার পরই ওই এলাকায় ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। বেলা সাড়ে ১১টার পর বৃষ্টি থেমে যায়।
বের করে আনা হলো ৭৮ জনকে
বেলা সোয়া ১১টার দিকে উদ্ধারকাজের বর্ণনা দিয়ে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল আতিয়া মহল নামের ওই বাড়ির বাসিন্দাদের বের করে আনে। আতিয়া মহল ও তার পাশের আতিয়া মহল-২ নামের আরেকটি ভবনের মাঝখানে ফায়ার সার্ভিসের মই দিয়ে সেতু তৈরি করা হয়েছে। এই পথে সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাসিন্দাদের বের করা হচ্ছে। সে সময় ফায়ার সার্ভিসকে বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখা গেছে। আটকে পড়া বাসিন্দাদের উদ্ধারের কাজ শেষ বলে বেলা সোয়া একটার দিকে জানিয়েছেন জালালাবাদ সেনানিবাসের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের এক কর্মকর্তা।
অভিযানে থাকা সেনা সদর দপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ব্রিফিংয়ে বলেন, তারা ওই ভবন থেকে ৭৮ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে। ভেতরে জঙ্গিদের অবস্থান রয়েছে। তাই তাদের অভিযান চলমান আছে। কাল রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযান সমাপ্ত করা হবে। আজ অভিযান চলাকালে জঙ্গিরা ১০-১২টি শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে।
দফায় দফায় গুলি-বিস্ফোরণ
দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত দফায় দফায় গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা বলেন, সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানার কাছে বেলা দুইটার একটু পর থেকে প্রায় সাড়ে তিনটা পর্যন্ত থেমে থেমে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এরপর প্রায় দেড় ঘণ্টা এমন কোনো শব্দ হয়নি। বিকেল পাঁচটা থেকে আবার গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় অনেকক্ষণ। এর মেধ্য বেলা পৌনে তিনটার দিকে আহত অবস্থায় শিবুল মালাকার (২৭) নামের একজনকে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, শিববাড়ির কাছেই পৈতপাড়া এলাকার বসন্ত মালাকারের ছেলে শিবুল। তিনি ঘটনাস্থলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর ফটো স্টুডিওর ব্যবসা আছে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওই ব্যক্তির শরীরের পেছনের দিকে গুলি লেগেছে। তাঁর অবস্থা শঙ্কামুক্ত। তিনি বর্তমানে হাসপাতালের চারতলায় সার্জারি ওয়ার্ডের ৪ নম্বর বেডে আছেন।
আধাঁরের সঙ্গে নামে আতঙ্ক
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে যেন আতঙ্কও নেমে আসে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এবং পুলিশ ও সোয়াটের সহায়তায় চলা ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা হয়। আতিয়া মহল থেকে উদ্ধার করা বাসিন্দাদের পাঠানপাড়ার একটি ভবনে রাখা হয়। ওই ভবনের সামনে সেনাবাহিনী ব্রিফিং করে। ব্রিফিং শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পর সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে ব্রিফিংস্থল থেকে কাছেই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় সাংবাদিকসহ ৩০ জনের বেশি আহত হন। এরপর রাত সাতটা ৫৫ মিনিটের দিকে আগের ঘটনাস্থলের কাছে পূর্ব পাঠানতলা মসজিদ এলাকায় আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ হয়। ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় ছয় পুলিশ সদস্যসহ আরও কয়েকজন আহত হন।
আরও পড়ুন:
সেনাবাহিনীর ব্রিফিংস্থলের কাছে বিস্ফোরণ, আহত কয়েকজন
সিলেটে অভিযান চলছে, আহত ১
থেমে থেমে গুলি-বিস্ফোরণের শব্দ
‘আতিয়া মহলে’ আবার গুলির শব্দ
‘আতিয়া মহল’ প্রাঙ্গণে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান
অভিযান চলছে, বাসিন্দাদের উদ্ধার শেষের পথে
‘আতিয়া মহলে’ আটকা মেয়ে, পথ চেয়ে পঙ্গু বাবা
অভিযান চলছে, গুলির শব্দ
অভিযান শুরু, গুলির শব্দ
অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি
ঢাকায় বিস্ফোরণে নিহত ১ : আইএসের দায় স্বীকার