মানুষ টাকা গুনতে পছন্দ করে, এটা অস্বীকার করার জো নেই। ১০ টাকাই হোক আর ১০ হাজারই হোক, টাকা গোনায় কোনো অপরাধও নেই। কিন্তু সমস্যা তখনই হয় যখন গুনে নেওয়া টাকাটা অন্যায়ভাবে অন্যের কাছ থেকে নিয়ে নিজের পকেটে ঢোকানো হয়।
ঘটনাটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকের। ওই সময় হাতে পাওয়া দুটি ভিডিও ফুটেজে টাকা নেওয়ার দৃশ্য দেখে নড়েচড়ে বসতে হলো। কারণ, যার কাছ থেকে ফুটেজ দুটি সংগ্রহ করেছি, তিনি জানিয়েছিলেন, টাকা নেওয়া ব্যক্তিটি পুলিশের এক কর্মকর্তা। আর যাঁরা টাকা দিচ্ছেন তাঁদের একজন শিশু অপহরণ মামলার আসামি।
আসামির কাছ থেকে পুলিশ কেন টাকা নেবেন? আর টাকা নিলে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবেন কীভাবে? যাঁর কাছ থেকে ভিডিও ফুটেজ পেয়েছি তাঁর কাছ থেকেই সংগ্রহ করলাম শিশু অপহরণ মামলা–সংক্রান্ত নথিপত্র। মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, ঘটনাটি আশুলিয়া থানার পূর্ব ধনিয়া এলাকার।
ঘুরতে বা ছোটখাটো প্রয়োজনে আগে দু–একবার গিয়েছি আশুলিয়ায়, পূর্ব ধনিয়া এলাকাটি একেবারেই অপরিচিত। কিন্তু ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে, ফুটেজ অনুযায়ী যিনি টাকা নিচ্ছেন ও যাঁরা দিচ্ছেন তাঁদের সম্পর্কে জানতে পূর্ব ধনিয়ায় যেতেই হবে। এলাকাটি প্রথমআলোর (সাভার) নিজস্ব প্রতিবেদক অরূপ রায়ের নখদর্পণে। যোগাযোগ করলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি নিয়ে গেলেন পূর্ব ধনিয়ায়। আমরা গেলাম আসামির বাসায়, বাদীর পুরোনো ঠিকানায়। জোগাড় করলাম বাদীর নতুন ঠিকানা, মোবাইল ফোন নম্বর এবং বাদীর দুজন আত্মীয়ের মোবাইল ফোন নম্বর। এরপর ফিরে এলাম ঢাকায়। বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের সঙ্গেই কথা হলো। দুই পক্ষের কাছে ঘটনার দু রকম বর্ণনা পেলাম।
আরও জানতে দু-এক দিন পর আবার গেলাম পূর্ব ধনিয়ায়। এবার কথা হলো স্থানীয় লোকজন, জনপ্রতিনিধিসহ অনেকের সঙ্গে। ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা জানালেন, ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর বিকেলে পূর্ব ধনিয়ার স্টারলিং গার্মেন্টসের পেছনের একটি বালুর মাঠে খেলতে যায় শেখ সুমনের সাড়ে চার বছরের ছেলে শেখ শাওন। এরপর থেকে আর তার সন্ধান নেই। এ ঘটনায় সুমন প্রথমে ওই বালুর মাঠের মালিক শাহাজদ্দিনকে সন্দেহ করেন এবং পরে অপহরণ মামলা করেন প্রতিবেশী মো. মাসুমের বিরুদ্ধে। প্রথমে আশুলিয়া থানা–পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে। পরে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর হয়। ফুটেজ দেখে স্থানীয় লোকজন নিশ্চিত করেন, যাঁরা টাকা দিচ্ছেন তাঁদের একজন ওই অপহরণ মামলার আসামি মাসুম। আর মাসুম জানান, যাকে তিনি টাকা দিয়েছেন তিনি সিআইডির উপপরিদর্শক ওবায়দুর রহমান। মামলার তদন্ত করতে এসেছিলেন তিনি।
মাসুমের কথায় বিশ্বাস করে তো প্রতিবেদন করা যায় না। কারণ, ফুটেজে যিনি টাকা নিচ্ছেন তিনি এসেছিলেন সাদাপোশাকে। আর যে পাজেরো গাড়িতে এসেছিলেন সেটিও পুলিশের নয়। কিন্তু আমাকে নিশ্চিত হতে হবে টাকা নেওয়া ওই ব্যক্তি সিআইডির কর্মকতা কি না।
প্রথমেই যোগাযোগ করলাম স্থানীয় পুলিশ ও পরিচিত এক সিআইডির কর্মকর্তার সঙ্গে। জানতে চাইলাম, সিআইডির ঢাকা বিভাগে ওবায়দুর রহমান নামে কোনো উপপরিদর্শক আছেন কি না। জানা গেল আছেন। এবার ওবায়দুর রহমানের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাঁকে ফোন দিলাম ফুটেজ–সংক্রান্ত বক্তব্যের জন্য।
বিপত্তি ঘটল এখানেই। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পরই রং নম্বর বলে ফোন রেখে দিলেন। এরপর একাধিকবার ফোন করেও তাঁর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। কিন্তু আমাকে তো নিশ্চিত হতে হবে। ফোন করলাম সিআইডির কন্ট্রোল রুমের নম্বরে। সেখানে চাইলাম ঢাকা বিভাগের উপপরিদর্শক ওবায়দুর রহমানের মোবাইল ফোন নম্বর। আমার সংগৃহীত করা নম্বর আর সিআইডির কন্ট্রোল রুম থেকে সংগ্রহ করা মোবাইল ফোন নম্বর মিলে গেল। কিন্তু ফোন করলে বলছে রং নম্বর। ঘটনা বুঝতে আর বাকি রইল না।
তারপরও ফুটেজ নিয়ে গেলাম সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে, ঢাকা বিভাগের বিশেষ সুপার আবু সুফিয়ানের কার্যালয়ে। তিনি ফুটেজ দেখলেন এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাঁর কক্ষে ডাকলেন ঢাকা বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার খোরশেদ আলমকে। খোরশেদ আলম নিশ্চিত করলেন ফুটেজে যে ব্যক্তি টাকা নিচ্ছেন তিনি ওবায়দুর রহমান। শিশু শাওন অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তিনি। এরপর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরির পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি ‘টাকা গুনে গুনে পকেটে নিলেন পুলিশ কর্মকর্তা’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়। ওই দিনই সাময়িক বরখাস্ত হন ওবায়দুর রহমান। এরপর অবশ্য দেখা হয়েছিল ওবায়দুরের সঙ্গে, কথা হয়েছিল মুখোমুখি বসে। কিন্তু এখনো সন্ধান মেলেনি নিখোঁজ শাওনের।