২৭৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, ব্যাংক হিসাবে লেনদেন ১৬৩৫ কোটি
তাঁর নিজ নামে ও স্বার্থ–সংশ্লিষ্টদের নামে পরিচালিত ঋণ হিসাব ছাড়া অন্যান্য ব্যাংক হিসাবে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তাঁর নিজের ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত হিসাবে টাকা জমা এবং ওই সব হিসাব থেকে তাঁর হিসাবে টাকা জমা করার তথ্যও পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মূল্যায়ন, এটা মানিলন্ডারিং আইনে অপরাধ।
ওই ব্যক্তির নাম প্রশান্ত কুমার হালদার। তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। আজ বুধবার সংস্থাটির ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি করা হয়।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রশান্ত কুমার হালদার ও তাঁর স্বার্থ–সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে যে সন্দেহজনক ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, এর মধ্যে তাঁর নিজ নামে পরিচালিত হিসাবগুলোয় ২৪০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ছিল। এ ছাড়া তাঁর মা লীলাবতী হালদারের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবে ১৬০ কোটি টাকা এবং তাঁর স্বার্থ–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন সময়ে ১ হাজার ২৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা হয়। দুদক বলছে, কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন প্রশান্ত কুমার হালদার।
গত সেপ্টেম্বরে দেশে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। এর পরপরই গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম ও অন্যান্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় আয়পূর্বক বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসংক্রান্ত যেসব অভিযোগ আসে, এসব বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর পর প্রথম তালিকাতেই প্রশান্তর নাম ছিল।
প্রশান্তর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করার পর তাঁর সম্পদের নানা তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রশান্ত কুমার হালদারের ব্যাংক হিসাবসংক্রান্ত তথ্য, আয়কর অফিস ও সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে সম্পদ–সম্পর্কিত তথ্য এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়।
সংগৃহীত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়কর নথিতে প্রশান্ত কুমার হালদার ৬২ কোটি ২৪ লাখ টাকা সম্পদ দেখিয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি ফ্ল্যাট, ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দামের আরেকটি ফ্ল্যাট এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬১ কোটি টাকা দামের ৩১৬৫ শতাংশ জমি ও ভবন রয়েছে।
কিন্তু প্রশান্ত কুমার হালদারের স্বার্থ–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনালের নামে রাজধানীর তেজতুরী বাজারে ১১০ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে, যার দাম ১২৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। বেনামে কেনা ওই জমির তথ্য তিনি আয়কর নথিতে দেখাননি। অনুসন্ধানে দুদক দেখেছে, লিপরো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের শেয়ার হোল্ডার উত্তম কুমার মিস্ত্রি কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, যাঁর নামে বরাদ্দকৃত শেয়ারের পরিমাণ পাঁচ হাজার। উত্তমের স্ত্রী রচনা মণ্ডলের নামে শেয়ারের সংখ্যা পাঁচ হাজার। পরে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেকটি কোম্পানির নামে লিপরো ইন্টারন্যাশনালের ৯০ হাজার শেয়ার বরাদ্দ করা হয়।
অনুসন্ধানের সময় ময়মনসিংহের ভালুকা সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দুদক দেখেছ, ভালুকার হাতীবেড় ও উথুরা মৌজায় ৫৮৯ শতাংশ জমি নিজ নামে কিনেছেন প্রশান্ত। এগুলোর দলিলমূল্য এক কোটি টাকা হলেও প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি।
অনুসন্ধানে প্রশান্ত কুমার হালদারের ৩২ কোটি ২৫ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক। আয়কর নথিতে ওই সব সম্পদের সপক্ষে সুনির্দিষ্ট আয়ের কোনো বৈধ উৎস দেখানো হয়নি।
এর বাইরে আটটি কোম্পানিতে প্রশান্ত কুমার হালদার এবং তাঁর নিকট আত্মীয় ও কর্মচারীদের নামে-বেনামে ৬৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বিনিয়োগের তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের নামে বিনিয়োগ, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনালের রাজীব সৌম এবং তার স্ত্রী শিমু রায়ের নামে ৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকার বিনিয়োগ আছে, যার প্রকৃত মালিক প্রশান্ত।
সুখাদা লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানে প্রশান্তর নিজ নামে বিনিয়োগ এবং অবন্তিকা বড়াল, প্রীতিষ কুমার হালদার ও সুস্মিতা সাহার নামে মোট ৩০ লাখ টাকার বিনিয়োগ আছে। নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির নামে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও অমিতাভ অধিকারীর নামে বিনিয়োগ আছে ৩০ লাখ টাকার। সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের সিদ্দিকুর রহমান, তাঁর স্ত্রী মাহফুজা রহমান, তাঁদের দুই ছেলে নিয়াজ রহমান সাকিব ও ইসতিয়াক রহমান ইমরান এবং মো. ইনসান আলী শেখের নামে মোট ২৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে প্রশান্তর।
আজিজ ফেব্রিকসের নামে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল এবং রামপ্রসাদ রায়ের নামে ৬২ লাখ ৮৮ হাজার টাকার বিনিয়োগ আছে। আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের নামে অভিজিৎ অধিকারী তীর্থ এবং প্রীতিষ কুমার হালদারদের নামে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার বিনিয়োগ আছে।
ক্লিউইস্টন ফুড অ্যান্ড অ্যাকোমোডেশন লিমিটেডের নামে আবদুল আলিম চৌধুরী, জাহাঙ্গীর আলম, সিদ্দিকুর রহমান, রতন কুমার বিশ্বাস, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, অমিতাভ অধিকারী, সিমটেক্স টেক্সটাইল জেড এ অ্যাপারেলস, আলমগীর হোসেন, পিঅ্যান্ডএল এগ্রো ফার্মস, আনান কেমিক্যালস এবং উইনমার্ক লিমিটেডের নামে বিনিয়োগ আছে ৩১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার। ক্লিউইস্টন ফুড অ্যান্ড অ্যাকোমোডেশন লিমিটেডের মালিকানায় কক্সবাজারে নির্মিত হচ্ছে পাঁচ তারকা হোটেল রেডিসন। ইতিমধ্যে হোটেলটির পাঁচতলা ভবন নির্মাণ হয়ে গেছে।
এ ছাড়া রহমান কেমিক্যালসের নামে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, রেপটাইলস ফার্ম, আর্থস্কোপ লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, রহমান কেমিক্যালস, রতন কুমার বিশ্বাস, রাজীব সৌম, অমিতাভ অধিকারী, আনন্দ মোহন রায়, প্রশান্ত কুমার চক্রবর্তী এবং তাঁর (প্রশান্ত কুমার হালদার) নিজ নামে মোট ৬৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকার বিনিয়োগ আছে।
দুদকের এজাহারে বলা হয়েছে, প্রশান্ত কুমার হালদারের নামে-বেনামে ১৮৭ কোটি ৭৮ লাখ ৫২ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ, ৯৯ কোটি ৬১ লাখ ২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট সম্পদের পরিমাণ ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার। অনুসন্ধানের সময় পাওয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সালে তাঁর বার্ষিক মূল বেতন ছিল ৪৮ লাখ টাকা। এই হিসাবে ১৯৯৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বৈধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এটা বাদ দিলে তাঁর কাছে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ আছে।
এজাহারে আরও বলা হয়, প্রশান্ত কুমার হালদারের নামে ঢাকায় আর বাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট আছে। এ ছাড়া নামে ও বেনামে একাধিক প্রতিষ্ঠানও আছে বলে দুদকের কাছে তথ্য আছে। পাওয়া তথ্যমতে, অবৈধ ব্যবসাসহ বিভিন্ন অবৈধ উৎস থেকে অর্জিত সম্পদের বেশির ভাগই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। তাঁর এসব সম্পদের বিষয়ে মামলার তদন্তের সময় আন্তরাষ্ট্রীয় যোগাযোগের মাধ্যমে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হবে।
দুদকের এজাহারে আরও বলা হয়েছে, অনুসন্ধানের সময় প্রশান্তকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হলেও তিনি হাজির হননি। তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে তথ্য আছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে প্রথম দিনই রাজধানীর ইয়াংমেনস ফকিরাপুল ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কার করা হয়) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার হন কথিত যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মোহামেডান ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সম্রাটের সহযোগী এনামুল হক আরমান, জাকির হোসেন, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম (ফিরোজ), অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান (মিজান) ও তারেকুজ্জামান রাজীব।
গ্রেপ্তার হওয়া এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল অর্থের মালিক হওয়া, অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগ ওঠে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের অপকর্মে সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সাংসদ, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্নজনের নাম উঠে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের পাশাপাশি তাঁদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে দুদক। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। পরে আরও দুজনকে দলে যুক্ত করা হয়। দলের অন্য সদস্যরা হলেন উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. সালাহউদ্দিন, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, আতাউর রহমান ও মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী।
অনুসন্ধান দলের সদস্যরা গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন ব্যক্তির নাম যাচাই-বাছাই করে একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেন। সংস্থার গোয়েন্দা শাখার পক্ষ থেকে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়। পাশাপাশি র্যাব ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানেরা দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেন। সেসব তথ্য ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে এ পর্যন্ত ২০টি মামলা করে দুদক দল। এসব মামলা হয়েছে ঠিকাদার জি কে শামীম, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু, তাঁর ভাই রূপন ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ ও এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান, তাঁর স্ত্রী সুমি রহমান, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজীব, যুবলীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, জাকির হোসেন ও তাঁর স্ত্রী আয়েশা আক্তার সুমা এবং গণপূর্তের সিনিয়র সহকারী শাখা প্রধান মুমিতুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী জেসমিন আক্তারের বিরুদ্ধে।