জাতীয় কন্যাশিশু দিবস আজ
সুরক্ষা নেই, ধর্ষণের সহজ লক্ষ্য শিশুরা
জানুয়ারি-আগস্টে ৩০০-এর বেশি মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার। কন্যাশিশু দিবসের অঙ্গীকার সমতা। সহিংসতা নির্মূলের সেটা জরুরি শর্ত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর ভাগনির (১৪) চিকিৎসা চলছে। দেখতে ঢুকেছে মেয়েটির বড় বোন। একসঙ্গে দুজন ভেতরে যাওয়া যায় না, খালা তাই বাইরে অপেক্ষা করছেন।
এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিলে খালা বললেন, ১৯ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের একটি এলাকায় তাঁর বোনের মেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে এলাকার একটি ছেলে। মেয়েটির বাসার কাছেই তার মামার বাড়ি। সেখান থেকে রাত নয়টার দিকে সে একা বাসায় ফিরছিল।
পরিবারের লোকজন রাতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মেয়েটিকে পাননি। পরদিন সকালে আদাবর থানা থেকে ফোন করে তাঁদের জানানো হয়, একজন পথচারী মেয়েটিকে সেখানে দিয়ে গেছে। মেয়েটি বলে, আরও কয়েকজনের সাহায্যে ওই ছেলে তাকে নির্জন একটি বাড়িতে নিয়ে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে।
পুলিশ সন্দেহভাজন ছয়-সাতজনকে আটক করলে মেয়েটি তাদের মধ্য থেকে ছেলেটিকে শনাক্ত করে। খালা বললেন, মেয়েটি প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে আছে। পরিবারের সবাই বিপর্যস্ত। ইতিমধ্যে এলাকার প্রভাবশালী কয়েকজন বাড়িতে এসে বিষয়টি মীমাংসা করে নিতে বলেছেন।
ওসিসিতে তিন ধরনের সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের চিকিৎসা, পরামর্শসেবা, সুরক্ষা এবং আইনি সেবা দেওয়া হয়। দেশের ওসিসিগুলোতে এ বছর সবচেয়ে বেশি সেবা নিয়েছে যৌন সহিংসতা অর্থাৎ ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার ভুক্তভোগীরা।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচিতে দেশে এখন মোট ১১টি ওসিসি পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে পরিচালিত এই কেন্দ্রগুলোতে গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আড়াই হাজারের বেশি ভুক্তভোগী সেবা নিয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অর্ধেকের বেশি ছিল যৌন সহিংসতার শিকার। বাদবাকিরা শারীরিক সহিংসতা এবং অ্যাসিডসহ পোড়ানো সহিংসতার শিকার।
এই ভুক্তভোগীদের মধ্যে অবশ্য শিশুর সংখ্যা আলাদা করে পাওয়া যায়নি। তবে ওসিসিতে যুক্ত চিকিৎসকেরা বলেছেন, শিশু ভুক্তভোগীদের মধ্যে ধর্ষণের শিকারই বেশি হয়ে থাকে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের হিসাবেও শিশু ধর্ষণের ঘটনা অনেক বেশি। এমনকি কোভিডকালেও।
হিসাবগুলো বলছে, শিশুরা পরিবার বা পরিচিত পুরুষদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় বেশি। অভিযুক্তদের মধ্যে কিশোর বয়সীরাও আছে। ছোট্ট শিশুদের চকলেট, বিস্কুট, খেলনা দেওয়ার কথা বলে আড়ালে নিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, শিশুর ধর্ষণ সবচেয়ে বেশি ঘটায় তার নিকটজনেরাই। শিশুদের বাধা দেওয়া বা প্রতিবাদ করার ক্ষমতা কম। তাই তারা সহজ লক্ষ্য।
শিশু ধর্ষণের দীর্ঘ তালিকা
বিলকিস বেগম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ডিএমসিএইচ) ওসিসির সমন্বয়ক। ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের শয্যা আছে আটটি। সেদিন ভর্তি ছিল মোট ১৪ জন। ৯ জনই শিশু। সব কটি ছিল ধর্ষণের ঘটনা। আট ও পাঁচ বছরের দুটি শিশুকে ধর্ষণ করেছেন প্রতিবেশী দুই পুরুষ।
বিলকিস বেগম শিশুদের ধর্ষণকারী হিসেবে সচরাচর পরিচিতজন বা পরিবারের লোকজনের নামই পান। সম্প্রতি কিশোরী ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছেন মুঠোফোন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিত পুরুষেরা। তাঁর মতে, স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটে পর্নো ছবি দেখার অভ্যাস ধর্ষণের চর্চা বাড়াচ্ছে।
নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৪টি দৈনিক পত্রিকার তথ্যের ভিত্তিতে নারী ও শিশু নির্যাতনের হিসাব রাখে। হিসাবটি বলছে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট সময়কালে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আত্মহত্যা, শ্লীলতাহানি, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হয়েছে ৮৬৮ শিশু।
এই আট মাসে মোট ৫৪৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার ৩৫৭ জনই শিশু। আরও ১৩ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৩০ শিশু।
ডিএমসিএইচে ওসিসিতে ভুক্তভোগী শিশুদের স্বজনের সঙ্গে কথা হয়। এক মা বলেন, এক আত্মীয় মারা যাওয়ার খবর পেয়ে দু-তিন ঘণ্টার জন্য বেরিয়েছিলেন। টিনচালার ভাড়া বাসায় আট বছরের মেয়েটি একা ছিল। আরেকজন ভাড়াটে মেয়েটিকে টয়লেটে নিয়ে ধর্ষণ করেন।
মাসখানেক আগে রাজশাহীর একটি উপজেলা শহরে বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী দুই শিশুকে ধর্ষণ করে পাশের ঘরের ভাড়াটে এক কিশোর। পুলিশ তাকে আটক করেছে। ভুক্তভোগী এক শিশুর বাবা মুঠোফোনে বললেন, পুলিশের এক কর্মকর্তা বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন।
এই বাবা বলেন, ‘আমার অবুঝ বাচ্চাটার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটাল! বিচার পেতে যত দিন দরকার, আমি মামলাটি চালিয়ে যাব।’
বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৮৯টি নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আসক নয়টি জাতীয় দৈনিক ও কয়েকটি অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সংকলন করে।
আসক বলছে, এই আট মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৩০৩টি। এক-তৃতীয়াংশের বেশি ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ছিল ৭ থেকে ১২ বছর। ধর্ষণের পর হত্যা করা ৪১ জনের মধ্যে ১৫ জন ছিল শিশু।
আরও দুই শিশুকে হত্যা করা হয়েছে ধর্ষণের চেষ্টার পর। এ ছাড়া ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে মোট আটজন নারী ও শিশু। তাদের সাতজনই শিশু।
করোনাকালেও মাপ নেই
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামে শামিল আছে নারী ও শিশু বিষয়ে কাজ করা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ১৮৮টি সংগঠন। এ মোর্চার সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে ধর্ষণসহ শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বেড়েছে।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন করোনাকালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা নিয়ে টেলিফোনে একটি জরিপ করেছে। এতে ৫৩টি জেলা থেকে মোট প্রায় ১৬ হাজার শিশু অংশ নেয়। জরিপটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১০ জুন।
গত মে মাসে পরিচালিত এ জরিপ ২ হাজারের কিছু বেশি শিশুর সহিংসতার শিকার হওয়ার হিসাব দিচ্ছে। তাদের তিন-চতুর্থাংশ পরিবারের মধ্যে শারীরিক, মানসিক, যৌন ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার শিশুদের ৬২ শতাংশ মেয়ে।
এ ছাড়া শিশুরা বাল্যবিবাহ, কাজের জায়গায় সহিংসতা, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির চেষ্টার শিকার হয়েছে। এসব নির্যাতনের শিকার শিশুদের ৬৮ শতাংশ মেয়ে। শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯টি। ১৩টি মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।
মনস্তত্ত্ববিদ হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলছেন, ছোটবেলা থেকে পরিবারে আদর্শিক বিকাশ না ঘটলে, আবেগ প্রকাশের সুযোগ না থাকলে এবং নৈতিকতার চর্চায় উৎসাহ না পেলে বড় হয়ে মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুর সহিংসতা দেখা দেয়।
চারপাশে ঘটে চলা অপরাধের ঘটনা কোনো মানুষকে অপরাধপ্রবণ করতে পারে। অধ্যাপক হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, গণমাধ্যমে তাই ধর্ষণসহ নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশের পাশাপাশি বিচার ও শাস্তির তথ্য সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা উচিত।
কন্যাশিশু দিবস, সমতা ও ধর্ষণ
আজ ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্ধারিত দিনে দিবসটি পালিত হচ্ছে। তবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবার দিবসটি নির্ধারিত দিনের পাঁচ দিন পর ঢাকায় পালন করবে। অক্টোবরের প্রথম সোমবার অর্থাৎ ৫ তারিখ বিশ্ব শিশু দিবস আর শিশু অধিকার সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে ৬ অক্টোবর পালন করা হবে।
সেই সঙ্গে মিলিয়ে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস পালিত হবে ৬ অক্টোবর। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘আমরা সবাই সোচ্চার, বিশ্ব হবে সমতার’। এটা ধর্ষণ, সহিংসতা আর নির্যাতন নির্মূল করারও একটি গোড়ার কথা।
নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে দুই দশকের বেশি সময় গবেষণা করছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রুচিরা তাবাসসুম নভেদ। ধর্ষণকারী পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও তাঁর গবেষণা আছে।
প্রথম আলোকে রুচিরা বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বা নির্যাতনের নানামাত্রিক কারণ রয়েছে। একটা বড় কারণ হচ্ছে, পুরুষ নিজেকে ক্ষমতাধর এবং নারীকে অধস্তন মনে করেন। জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নির্যাতক পুরুষ ধর্ষণ বা নির্যাতনকে নিজের অধিকার বলে ভাবেন।
অনেকে নিছক মজার জন্যও এমন কাজ জায়েজ মনে করেন। রুচিরা বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন আর ধর্ষণসহ সহিংসতা থামানোর পথটি সহজ নয়। সে জন্য ক্ষমতার অসমতা নির্মূল করতে হবে। চাই দৃষ্টিভঙ্গির বদল। মানসিকতা-মূল্যবোধ, প্রতিকার-প্রতিরোধ—সব ক্ষেত্রে সমন্বিত কাজ চাই।