সুন্দরবনের খাঁটি মধুর নামে হচ্ছেটা কী
সুন্দরবনের খাঁটি মধুর কদর দেশজোড়া। সেই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে সুন্দরবন–সংলগ্ন বাগেরহাটের মোংলা উপজেলাসহ আশপাশের এলাকায় সুন্দরবনের খাঁটি মধুর নামে চলছে ভেজাল মধুর ব্যবসা।
একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চক্র অতি মুনাফার আশায় সুন্দরবন থেকে সংগৃহীত মধুতে ভেজাল দিয়ে বাজারে তা উচ্চ দামে বিক্রি করছে। ভেজাল মধু শনাক্ত করার সাধারণত কোনো উপায় না থাকায় পর্যটকসহ ক্রেতাসাধারণ তা কিনে প্রতারিত হচ্ছে।
সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর এপ্রিল ও মে মাসে বন বিভাগের রাজস্ব প্রদান সাপেক্ষে মৌয়ালরা সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের অনুমতি পায়। এই মধু আহরণ মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার পরপরই একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চক্র মধুতে ভেজাল দিয়ে বাজার ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সুন্দরবনের খাঁটি মধুর মোড়ক লাগিয়ে বিক্রি করা শুরু করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অসাধু ব্যবসায়ী চক্রটি সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই মৌয়ালদের মোটা অঙ্কের টাকা দাদন দেয়। দাদনবাজ ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা লাভের আশায় বনের অভ্যন্তরে থাকা অবস্থাতেই সংগৃহীত মধুর সঙ্গে চিনির শিরা ও অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে পরে লোকালয়ে আনতে বলে দেয়। মৌয়ালদের একাংশ ভেজাল মধু তৈরির উপকরণ, সরঞ্জামসহ মৌসুমে বনে প্রবেশ করে। সুন্দরবনের চাঁদপাই, ঢাংমারী, শরণখোলা, নলিয়ান ও বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জের বিভিন্ন অফিস থেকে মৌয়ালরা অনুমতি নিয়ে বনে প্রবেশ করে সংগৃহীত মধুর সঙ্গে অন্যান্য উপাদান মিশিয়ের ভেজাল মধু তৈরি করে। এ ছাড়া অনেক সময় বন থেকে আহরিত মধু লোকালয়ে এনে চাষের মধু মিশিয়েও ভেজাল দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও বন বিভাগের এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো তৎপরতা নেই।
সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের অন্তর্গত জয়মণি বাজার, বৈদ্যমারী, জিউধরা, ঢাংমারী, বাণীশান্তা, লাউডোব গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গ্রামবাসী জানান, বনে এখন আর আগের মতো মধু পাওয়া যায় না। মধু আহরণ মৌসুমের শুরুতে গরান ও খলসী ফুলের মধুর মৌসুম এবং শেষের দিকে কেওড়া ফুলের মধুর মৌসুম। কিন্তু বনে গরান ও খলসী এই দুই জাতের গাছের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। তাই একশ্রেণির অসৎ মৌয়াল অধিক লাভের আশায় নকল মধু বানানোর জন্য বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে বস্তাভর্তি চিনি ও বড় বড় পাতিল নিয়ে বনে যায়। এই ভেজাল মধু তৈরির জন্য শরণখোলা, চাঁদপাই, কয়রা, শ্যামনগরসহ বনসংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে শতাধিক লোক জড়িত। মোংলায় এ চক্রের শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে।
সুন্দরবন–সংলগ্ন হওয়াতে মোংলায় গড়ে উঠেছে পর্যটন ব্যবসা। এখানে বছরের অধিকাংশ সময়ই পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন স্থানে সুন্দরবনের মধু বিক্রির দোকান গজিয়ে উঠেছে।
গত শনিবার মোংলার মেইন রোড, শেখ আ. হাই সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, মুদিদোকান, কাপড়ের দোকান, ওষুধের দোকান, ফলের দোকান, পান–সিগারেটের দোকান, বেকারি, জুতার দোকান এমনকি সেলুনেও সুন্দরবনের খাঁটি মধুর লেবেল লাগিয়ে ভেজাল মধু বিক্রি করা হচ্ছে। সব স্থানে প্রকারভেদে প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা দরে এ মধু বিক্রি করা হচ্ছে।
সুন্দরবনের মৎস্য ব্যবসায়ী ও দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সম্পাদক কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সুন্দরবনের মৌয়ালদের কারও কারও বিরুদ্ধে ভেজাল মধু তৈরির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে বন বিভাগের উদাসীনতাও বরাবরেরই। তাদের অবশ্যই এ বিষয়ে কঠোর হওয়া উচিত।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য সুন্দরবনের চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের মধু দেশের ঐতিহ্য। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বিদেশেও এ মধু রপ্তানি করা সম্ভব। কিছু ব্যবসায়ীর জন্য মধুর এই বাজার ধ্বংস হতে বসেছে।
পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা শাহিন কবীর বলেন, ভেজাল মধু তৈরির অভিযোগ তিনি শুনেছেন। মোংলাসহ আশপাশের দোকানে প্রশাসন যদি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে, তাহলে মধুতে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা কমবে।
মোংলার ইউএনও মো. রাহাত মান্নান বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে মধুতে ভেজাল দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছি। খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’