সাঁওতালপল্লিতে আতঙ্ক, পুরুষেরা বাড়িতে নেই

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পর গির্জার সামনে সমবেত নারীরা। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পর গির্জার সামনে সমবেত নারীরা। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো

অলিভিয়া হেমব্রমের তিন ছেলে। ছোটটি কোলে, বড় আর মেজ মায়ের দুপাশে দাঁড়িয়ে। ভীত-বিহ্বল মুখ। তাদের বাবা দ্বিজেন টুডুর চোখে গুলি লেগেছে। অলিভিয়া স্বামীর খবর খুব বেশি জানেন না। তিনি জানেন, ঢাকায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। অবস্থা একটু ভালো।

দ্বিজেন ৬ নভেম্বর গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হন। প্রথমে তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় পাঠানো হয়।

গতকাল মঙ্গলবার সাঁওতালপল্লিতে ঘুরে দেখা গেল, এখানে তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। গ্রামে পুরুষের সংখ্যা অল্পই। গ্রেপ্তারের ভয়ে তাঁরা পালিয়ে আছেন। নারী আর বয়স্করা মূলত মাদারপুর গির্জার সামনে এসে জড়ো হয়েছেন। এখানে মাদারপুর, বড় জয়পুর, ছোট জয়পুর—এই তিনটি গ্রামে প্রায় সাড়ে বারো শ সাঁওতাল পরিবারের বাস। তাদের প্রায় অর্ধেক খ্রিষ্টান। পল্লির পূর্ব পাশে রংপুর চিনিকলের ১ হাজার ৮৪২ একরের সাহেবগঞ্জ আখের খামার। মাঝখানে শুধু মেটে রাস্তা। খামারের জমিগুলো ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করা হয়। এর সিংহভাগ ছিল সাঁওতাল এবং অল্প কিছু আশপাশের মুসলিম ও হিন্দু পরিবারের। এখন সব জমিতে আর আখ চাষ হয় না। এই জমি ফেরত চেয়ে সাঁওতালরা ২০১২ সাল থেকে আন্দোলন করছে। বেশ কয়েকবার এখানে ঘরও তোলা হয়েছিল। সেসব ঘর মিল কর্তৃপক্ষ ভেঙে দেয়। চলতি বছরের গত ১ জুলাই সাঁওতালরা হরিণমারি, সাহেবগঞ্জ, মাদারপুর ও কুয়ামারা মৌজায় দুই শতাধিক একচালা ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করে। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় চিনিকল কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযান চালায়। চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক পুলিশ-র‍্যাব উচ্ছেদে অংশ নেয়। এতে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তিনজন মারা যান।

এ ব্যাপারে গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত সরকার বলেন, পুলিশ তাদের হয়রানি করছে না বা ভয়ভীতি দেখাচ্ছে না; বরং তাদের নিরাপত্তার জন্য টহল দিচ্ছে।

গবাদি পশুপাখি ও টিনের চাল লুট: ৬ নভেম্বর রোববার সন্ধ্যায় আখের খামারের জমিতে তৈরি এক চালাঘর উচ্ছেদের সময় এবং পরদিন খুব ভোরে আবার মূল সাঁওতালপল্লিতে হামলা হয়। একদল লোক তাদের বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট চালায় বলে অভিযোগ করল সাঁওতালরা। বিশেষ করে তাদের গরু, ছাগল, ভেড়া, শূকর ও হাঁস-মুরগি লুট হয়ে যায়। অনেক বাড়ি থেকে টিন খুলে নেওয়া হয়। ফুলমনি হেমব্রেমের লুট হয়েছে দুটি গাভি ও একটি এঁড়ে বাছুর। আনচেল মুর্মুর দুটি গরু লুট হয়েছে। এজিকেল মুর্মু, দিলীপ মুর্মু, জামিল হেমব্রেমসহ অনেকে অভিযোগ করলেন, তাঁদের চাঁদা তুলে কেনা চারটি পাওয়ার টিলার ও চারটি শ্যালো মেশিন লুট হয়েছে। সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমিন বাস্কে বলেন, ‘ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও সরকার সাঁওতাল হত্যা, ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় কোনো তদন্ত কমিটি করেনি। আমরা এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই।’

গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়িছাড়া: সংঘর্ষের ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং তিন থেকে চার শ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে থানায় মামলা করে। এরপর পুলিশ প্রায়ই এসে গ্রামে টহল দিচ্ছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে অধিকাংশ পুরুষ পালিয়ে আছেন। গতকাল মাদারপুর গির্জার সামনে উপস্থিত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিলেন নারী। কয়েকটি দাতা সংস্থা তাঁদের ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে। সেসব নিতেই এসেছিলেন। তাঁরা বললেন, সংঘর্ষে তাঁদের অনেক লোক আহত হয়েছেন। গ্রেপ্তারও করা হয়েছে অনেককে। অনেকে গ্রেপ্তার এড়াতে গোপনে চিকিৎসা করাচ্ছেন। এ জন্য সঠিক কত লোক আহত হয়েছেন, নিখোঁজ কত, লুটপাটে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণইবা কত, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যাচ্ছে না।

শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে না: ঢাকায় চিকিৎসাধীন দ্বিজেনের স্ত্রী অলিভিয়া বললেন, তাঁর বড় ছেলে ইলিয় টুডু চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ওই ঘটনার পর থেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ। শুধু দ্বিজেনের ছেলে নয়, এই তিনটি সাঁওতাল গ্রামের শতাধিক শিশু-কিশোরের কেউই স্কুলে যাচ্ছে না।

গতকাল শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদের অনুরোধ করতে গির্জার সামনে এসেছিলেন বুজরুক বেড়া আরজি আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মামুনুর রশীদ। তিনি জানালেন, তাঁর স্কুলে আদিবাসী শিক্ষার্থী ৯০ জন। কেউ স্কুলে যাচ্ছে না। এ ছাড়া পাশেই সাহেবগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কাঁচা কৃষ্ণপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়েও সাঁওতাল শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে না বলে জানা গেল। অভিভাবকেরা বললেন, তাঁরা এই পরিস্থিতিতে সন্তানদের বাড়ি থেকে বের হতে দিতে সাহস পাচ্ছেন না। এখনো রাস্তায় চলাচল করার সময় বিচ্ছিন্নভাবে সাঁওতালদের ওপর হামলা হচ্ছে। কারা হামলা করছে জানতে চাইলে তাঁরা জানান, একটি প্রভাবশালী মহল এত দিন চিনিকল থেকে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করত। তারা ও তাদের লোকেরাই সাঁওতালদের ওপর হামলা করছে। এদের নাম উল্লেখ করতে চাননি তাঁরা।

গতকালও সরকারি ত্রাণ নেননি: চার্চের সামনে লাইনে ছিলেন সুখী সরেন। গতকাল খ্রিষ্টান ও সনাতনধর্মী সাঁওতাল এবং হিন্দু-মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে বেসরকারি উদ্যোগে দেওয়া হলো একটি করে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল আর একটি করে গ্লাস, চামচ ও থালা। এর আগে আরও বেসরকারি উদ্যোগে দুই দফায় পরিবারপ্রতি ১০ কেজি করে চাল, ২ কেজি আলু, ১ কেজি মসুর ডাল ও ১ লিটার সয়াবিন, ১টি করে শাড়ি ও লুঙ্গি দেওয়া হয়েছিল। গতকালও তাঁরা সরকারি ত্রাণ নেননি। বৃদ্ধ সিমন কিসকুর ঘর পুড়েছে, বলদ লুট হয়েছে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে ‘মুষ্টির চাল’ দিতে এসেছেন!

 দুজন কারাগারে: রংপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ঘটনায় আহত ও রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন দুই সাঁওতালকে গতকাল গাইবান্ধা কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাঁরা দুজন আপাতত সুস্থ হয়ে ওঠায় ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এই দুজন হলেন মাদারপুর গ্রামের বিমল কিচকু (৪০) ও চরণ সরেণ (৫০)।

ভূমিদস্যুরা সাঁওতালদের ব্যবহার করেছে: ঢাকায় নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের যে ভূমি নিয়ে সমস্যা চলছে, সেটি সাঁওতালদের জায়গা ছিল না। ভূমিদস্যুরা সাঁওতালদের ব্যবহার করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাঁওতালদের দিয়ে দখল করিয়ে পরে নিজেদের দখলে নেওয়া। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনার পেছনে স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজশ থাকতে পারে বলেও মনে করেন শিল্পমন্ত্রী। তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন জায়গায় মন্দির ভাঙা বা এ ধরনের ভাঙচুরের ঘটনাগুলো ঘটছে। স্বার্থান্বেষী মহলের পরিচয় জানতে চাইলে শিল্পমন্ত্রী বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে তা বের করা হবে। এ পর্যন্ত ৮৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক প্রমুখ।