সন্দেহভাজন মুসাকে করোনা রোগী দেখানো হয়েছে আদালতে

গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার শাহজাহানপুরে সড়কের এই জায়গায় গুলি করে হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপুকে। সে সময় ঘাতকের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়েছিলেন কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামাল।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর শাহজাহানপুরে ব্যস্ত সড়কে গুলি করে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যার অন্যতম সন্দেহভাজন সুমন শিকদার ওরফে মুসাকে খুঁজে পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে ঢাকার আদালতে তাঁর আইনজীবীর জমা দেওয়া আবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন মুসা।

সুমন শিকদার ওরফে মুসার বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১১টি মামলা রয়েছে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, মুসা একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশ গ্রুপের হয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। পরে শাহজাহানপুর-খিলগাঁও এলাকার পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ ওরফে মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিকের হয়েও কাজ করতেন।

ছয় বছর আগে মতিঝিলে যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যা মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি মুসা। গত বৃহস্পতিবার শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলামসহ দুজনকে গুলি করে হত্যার পর তিনি আদালতে হাজির হননি। তাঁর পক্ষে দুই দফায় আইনজীবী আদালতে লিখিতভাবে বলেছেন, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

তবে গত মঙ্গলবার র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, জাহিদুল হত্যাকাণ্ডের পর দেশে মুসার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে হয়তো তিনি দেশ ছেড়েছেন।

রিজভী হত্যা মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল–১–এ বিচারাধীন। রাষ্ট্রপক্ষে এই মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া আজ প্রথম আলোকে বলেন, রিজভী হত্যা মামলায় অন্যতম সাক্ষী ছিলেন সম্প্রতি খুন হওয়া জাহিদুল ইসলাম। এই মামলায় তাঁর সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল। তবে জাহিদুল খুন হওয়ার পর থেকে রিজভী হত্যা মামলায় অভিযুক্ত মুসাসহ চারজন আদালতে হাজির হননি। মুসার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তিনি নাকি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ওই আবেদনে আপত্তি দেওয়া হয়েছে।

মুসা ছাড়াও রিজভী হত্যায় অভিযুক্ত অপর তিন আসামি ওমর ফারুক, আবুল সালেহ শিকদার ও নাসির উদ্দিনও গতকাল আদালতে হাজির হননি। জামিনে থাকা এই তিনজনের পক্ষে আদালতে সময় চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে শুধু আসিফ মোশাররফ আদালতে হাজির হয়েছিলেন। অন্য চার আসামির মতো তিনিও জামিনে রয়েছেন।

জানতে চাইলে মুসার আইনজীবী শাহনেওয়াজ বেগম আজ সন্ধ্যায় টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুসা বেশ কয়েক দিন আগে থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর করোনা পজিটিভ হওয়ার সনদ আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।’
রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকার সড়কে গত বৃহস্পতিবার রাতে জাহিদুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন এলোপাতাড়ি গুলিতে কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামালও নিহত হন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মাসুম মোহাম্মদ আকাশ নামের এক ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। জাহিদুল হত্যার পর পুলিশ ও র‌্যাব সন্দেহভাজন হিসেবে যাঁদের খুঁজছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মুসা।

এই হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের অনুমতি নিয়ে মাসুমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হত্যার কারণ এবং কারা জড়িত, সেসব তথ্য বের করার চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন

রিজভী হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলেন জাহিদুল

মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে গুলি করে স্থানীয় যুবলীগের কর্মী রিজভী হাসানকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় করা হত্যা মামলার তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ৫ মার্চ মুসাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলি করা হয়। পরে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১–এ বদলি করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গত বছরের ১৮ আগস্ট পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রপক্ষের ৩৫ জন সাক্ষীর তালিকায় জাহিদুল ইসলামের নামও রয়েছে।

আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ মামলায় রিজভীর বাবাসহ ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।

সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, রিজভী মতিঝিলের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। খুন হওয়ার আগে তিনি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ওই এলাকায় চাঁদার টাকার ভাগ পেতেন। ফুটপাতের দোকান, মুরগিপট্টি, কাঁচাবাজারসহ কেবল ও পানির ব্যবসা থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। রিজভী ২০১৩ সালে অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হন। পরে জামিনে বেরিয়ে আসার পর তিনি বেশি করে চাঁদা নিতেন। এ নিয়ে ওই এলাকার যুবলীগের কর্মী নাসিরের সঙ্গে তাঁর বিরোধ হয়।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের হস্তক্ষেপে মিটমাট হলেও প্রায়ই দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতে থাকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুক আর নাসির একই মোটরসাইকেল ব্যবহার করতেন। ওমর ফারুকের পূর্বপরিচিত ছিলেন মিরপুরের সুমন শিকদার ওরফে মুসা। পরে মুসার সঙ্গে নাসিরের পরিচয় করিয়ে দেন ওমর ফারুক। অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, রিজভী হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত ছিলেন মুসার ভাই আবু সালেহ শিকদার। তাঁর বিরুদ্ধেও পল্লবী থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

আরও পড়ুন

পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জাহিদুলের স্ত্রীর

আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম হত্যার পর সপ্তাহ হতে চললেও এই অপকর্মের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

জাহিদুলের স্ত্রী কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম আজ প্রথম আলোকে বলেন, হত্যার পরিকল্পনাকারীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তাঁরা আতঙ্কে রয়েছেন।
গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই তদন্ত করা হচ্ছে।