শেরেবাংলা হলজুড়ে মারধরের ভয়
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার আগের দিন শনিবার ইকবাল হোসেন নামের আরেক ছাত্রকে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা যায়।
ইকবাল শেরেবাংলা হলের ৪০০৭ নম্বর কক্ষে থাকেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে হলে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
হলের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আবরার হত্যার আগের দিন হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে ইকবালকে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ইকবালকে যাঁরা মারধর করেন, তাঁরা আবরার হত্যাকাণ্ডেও জড়িত।
শেরেবাংলা হলের অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতীতে তুচ্ছ কারণে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করেছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। গুরুতর আহত হওয়ার পরও ভয়ে এই শিক্ষার্থীরা কোথাও কারও কাছে অভিযোগ দেননি। এসব অন্যায় তাঁরা নীরবে সহ্য করেছেন। এখনো তাঁরা ভয়ের মধ্যে আছেন।
আবরার শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ কক্ষে থাকতেন। গত রোববার রাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আবরারকে এই কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যান হলের দ্বিতীয় তলার ২০১১ নম্বর কক্ষে। রাতে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী।
আবরারের ১০১১ কক্ষে থাকেন মিজান। তিনি গতকাল সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবরার আর আমি একই কক্ষে থাকতাম। ও খুব ভালো ছেলে ছিল। নিজের লেখাপড়া নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকত। কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। রোববার আবরারকে ডেকে নিয়ে যায়। রাত দুইটার পর শুনতে পাই, আবরার মারা গেছে।’
আবরারের কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন মিজান। একপর্যায়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
আবরার বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) ছাত্র ছিলেন। গতকাল হলে তাঁর কক্ষে পড়ার টেবিলে দেখা গেল, থরে থরে সাজানো বই। আবরারের একটা বই দেখিয়ে মিজান বলেন, ‘বইয়ের ভেতর এই কলমটা রেখেছিল আবরার। কারণ, এই বইটা সে পড়ছিল।’
আবরারের বিছানার ওপর পড়েছিল একটি কালো ব্যাগ। যে ব্যাগে রাখা তাঁর পরিচয়পত্র, জন্মসনদ, লিটল ম্যাগাজিন—নাম ভূর্জপত্র। আবরারের একটা পরীক্ষার ফলাফলের কাগজপত্রে দেখা গেল, লেভেল ওয়ান, টার্ম-দ্বিতীয়তে সিজিপিএ ৩.৪০।
আবরার হত্যার ঘটনায় ইতিমধ্যে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১৩ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে ১০ জনকে গতকাল পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এই ১০ জনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।
রিমান্ড শুনানিতে আসামিদের আইনজীবীরা আদালতে দাবি করেছেন, আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁদের মক্কেলরা জড়িত নন।
ভয় আর ভয়
শেরেবাংলা হলের একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী জানান, তাঁরা সব সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ভয়ে তটস্থ থাকেন।
আবরার যে রাতে খুন হন, সেই রাতে হলের প্রধান ফটকের সামনে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মো. সেলিম। নিরাপত্তারক্ষীদের বসার চেয়ার-টেবিলের পেছনের সিঁড়িতে রাখা হয়েছিল আবরারের লাশ।
আবরার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নিরাপত্তারক্ষী সেলিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না। যা ঘটেছে, তার সবই আছে সিসিটিভির ক্যামেরায়।’
সেলিম বলেন, ‘আমরা ছোট চাকরি করি। আবরার কীভাবে মারা গেছেন, কারা মেরেছেন, তা বলতে পারব না।’
আবরারকে মারধর করা হচ্ছে, সে খবর হলের অনেক ছাত্রই জানতেন। কিন্তু ভয়ে কেউ ২০১১ নম্বর কক্ষের দিকে যাননি বলে জানা গেল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হলের এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায়ই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে বা ধরে নিয়ে এই কক্ষে (২০১১) নির্যাতন করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ভয়ে কেউ কথা বলে না। এখনো আমরা ভয়ে আছি।’
শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন, এমন তিনজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, ছাত্রলীগের নেতারা তাঁদের কক্ষে ডেকে নিয়ে প্রথমে মোবাইল ও ল্যাপটপ কেড়ে নেন। এরপর বেধড়ক মারধর শুরু করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করা তাঁদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
অমিত হাসান নামের এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই হলে (শেরেবাংলা) যাঁরা থাকেন, তাঁদের কেউ না কেউ র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন। আমিও হয়েছি। ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে না গেলে নেতারা আমাদের হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন।’
পলিটিক্যাল রুম
শেরেবাংলা হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘পলিটিক্যাল’ রুমের সামনে দিয়ে তাঁদের সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করতে হয়। সালাম না দিলে ছাত্রলীগের বড় ভাইয়েরা মারধর করেন।
আবরারকে প্রথমে হলের যে কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করা হয়, সেই কক্ষে গিয়ে গতকাল দুপুরে দেখা যায়, চারটি ফ্যানই সচল। তবে কক্ষে কেউ নেই। আবরার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার বুয়েট ছাত্রলীগের উপ-সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকাল থাকতেন এই কক্ষে। তাঁর টেবিলের ওপর রাখা কম্পিউটারটি সচল অবস্থায় দেখা গেল। কক্ষের আরেক শিক্ষার্থী অমিত সাহার টেবিলের ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট। একই কক্ষের আরেক শিক্ষার্থী রাফিদের টেবিলের ওপর বইপত্র এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে। এই কক্ষে দেখা গেল, মোটা নাইলন দড়ি।
হলের একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থীর অভিযোগ, আবরার হত্যার আগে তুচ্ছ কারণে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল এবং বুয়েট ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতাছিম ফুয়াদ শিক্ষার্থীদের মারধর করতেন।
বুয়েটের রশিদ হলের ছাত্র ফাহিম আল হাসান মঙ্গলবার দুপুরে আসেন আবরারের কক্ষের সামনে। সাত মাস হলো ফাহিম হলে উঠেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুয়েটের একজন ছাত্রের গায়ে কেন হাত তোলা হবে? আবরার তো কোনো দোষ করেননি। আবরারকে কেন নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করল? আবরারের এই মৃত্যুকে আমি মেনে নিতে পারছি না। আমাদের আরেক বন্ধু অভিজিৎকে থাপ্পড় মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়া হয়।’