নেই চিংড়ির সত্যিকারের কোনো ঘের। তবু প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কারণে চিংড়িঘেরের ক্ষতি হয়েছে এমন দাবিতে ভুয়া কাগজপত্রে ক্ষতিপূরণ বাবদ ২২ কোটি টাকা লুট করেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এ থেকে বাদ পড়েননি বিএনপির নেতারাও।
কাজ শুরু না করতেই অর্থ হরিলুটের এ ঘটনা কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের। এ ঘটনায় ২১ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে সার্টিফিকেট মামলা এবং চারজনের বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা।
মৎস্যচাষি ও সংশ্লিষ্ট মামলা সূত্রে জানা যায়, দেশের বৃহত্তম এই তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থ লুটে এগিয়ে আছেন মাতারবাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম ও তাঁর স্বজনেরা। তিনি নিজের নামে দুই কোটি ২২ লাখ ও ছেলে আমিনুল ইসলামের নামে এক কোটি ৩৩ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য আরেক ব্যক্তি হলেন মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা আহসান উল্লাহ ওরফে বাচ্চু। তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন ৬৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। জালিয়াতিতে সহযোগিতা করেছেন জেলা প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। সহযোগিতার বিনিময়ে তাঁরাও নিয়েছেন বিপুল অঙ্কের অর্থ।
মহেশখালীর ধলঘাটা আর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের এক হাজার ৫০০ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ‘মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প’। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের সহযোগী সংস্থা জাইকা। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শুরু হওয়ার কথা।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ২৪ আগস্ট মাতারবাড়ীতে এক অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সিপিজিসিবিএলের কাছে প্রকল্পের জমি হস্তান্তর করেন। করা হয় একটি চুক্তিও। সরকারের পক্ষে জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলও) আরেফিন আখতার নূর চুক্তিতে সই করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে প্রকল্পের জমিতে মাছের ১০টি ঘের। কিন্তু মহেশখালী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান ১০৯ ব্যক্তিকে মালিক ও অংশীদার দেখিয়ে ২৫টি ঘেরের তালিকাসংবলিত এক প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন জেলা প্রশাসনে।
স্থানীয় মৎস্যচাষিদের ভাষ্য, ঘুষের বিনিময়ে তৈরি করা এই তালিকার ৮০ শতাংশ অংশীদারই ভুয়া। ঘেরগুলোতে মূলত বাটা, কোরাল, টেংরা, কাঁকড়া, তেলাপিয়ার চাষ হয়। অথচ এগুলোকে শতভাগ চিংড়িঘের হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মশিউর রহমান ওই এলাকায় ঠিক কতটি ঘের আছে তা তাঁর জানা নেই বলে জানান। তবে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
ক্ষতিপূরণ তালিকার এক নম্বরে থাকা মাতারবাড়ীর টিয়াকাটা চিংড়িঘেরের মালিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তাঁর ঘেরের কোনো ক্ষতি না হলেও জেলা প্রশাসন থেকে প্রায় ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তিনি। এই ঘেরের অংশীদার দেখিয়ে ভুয়া ১১ ব্যক্তির নামে (অভিযুক্ত ২১ জনের অন্তর্ভুক্ত) ১০ কোটি ৯৩ লাখ ৫৬৪ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
তালিকায় দুই নম্বরে মগডেইল্যা চিংড়িঘোনার মালিক মোহাম্মদ হোছাইন। ঘেরটিতে বাটা, কাঁকড়া, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন মাছের চাষ হয়। কিন্তু ছয় ব্যক্তিকে এর মালিক ও অংশীদার দেখিয়ে ‘চিংড়িঘের’ হিসেবে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ছয় কোটি ২১ লাখ টাকা। মোহাম্মদ হোছাইন বলেন, তাঁর এই ঘেরের নামে বিএনপির নেতা রফিকুল ইসলাম, তাঁর ছেলেসহ চার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ তুলে নিয়েছেন প্রায় তিন কোটি টাকা।
আরেকটি ঘের রোস্তমদুনার মালিক মো. মামুন বলেন, তাঁর ঘেরের নামেও কয়েক কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।
অভিযোগের ব্যাপারে বিএনপির নেতা রফিকুল বলেন, ‘কাগজপত্র দাখিল করেই চিংড়ির ক্ষতিপূরণ নিয়েছি। টাকা ফেরত দিতে আদালতের নোটিশও পেয়েছি। নোটিশের জবাব দেওয়া হবে। এর পরও হয়রানি করলে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেব।’
আর আহসান উল্লাহ বলেন, ‘প্রশাসনের কর্মকর্তারা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই টাকার চেক হস্তান্তর করেন। এ জন্য আমি দোষী হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে।’
জাইকার স্থানীয় প্রতিনিধি রেজাউল করিম বলেন, চিংড়িঘেরের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে এ পর্যন্ত কোনো দল এলাকা পরিদর্শন করেছেন কি না, তা তাঁর জানা নেই। টিয়াকাটা চিংড়িঘোনার পরিচালক আবু ছৈয়দও একই কথা বলেন।
মামলা দায়ের: ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আরেফিন আখতার গত ৮ অক্টোবর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২১ ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রায় ২২ কোটি টাকার সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করেছেন। অর্থ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের চার কর্মচারী আবুল কাশেম মজুমদার, আবদুল কাদের, ফখরুল ইসলাম ও বাদশা মিয়ার বিরুদ্ধেও দায়ের করা হয় একটি বিভাগীয় মামলা।
পরে ১২ অক্টোবর জেনারেল সার্টিফিকেট কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এক মাসের মধ্যে (গতকাল ১৭ নভেম্বর) সব টাকা ফেরত দিতে নোটিশ পাঠান।
মামলা নিয়ে রহস্য: যাঁর সই করা চেক নিয়ে ২২ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে, এসব মামলার বাদী সেই আরেফিন আখতার হওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে রহস্যের। অনেকেই বলছেন, দুর্নীতির টাকা জায়েজ করিয়ে নিতেই লোকদেখানো এই মামলা।
এ প্রসঙ্গে আরেফিন বলেন, ‘চেক দেওয়ার আগে ভালোমতো কাগজপত্র দেখার সুযোগ পাইনি। যখন জেনেছি অনিয়ম হয়েছে, তখন ২১ প্রতারক ও জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ঠিক নয়।’
কয়েক আসামির ভাষ্য: সার্টিফিকেট মামলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আসামি বলেন, জেলা প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষতিপূরণের চেক বিতরণের বিপরীতে অন্তত ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। উচ্চপর্যায়ের তদন্তে থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়বে।
বিভাগীয় মামলার এক আসামি সার্ভেয়ার ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘কারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, তা সময় এলেই ফাঁস হবে। আমি দুর্নীতিতে যুক্ত নই, পরিস্থিতির শিকার।’
একই মামলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক আসামি বলেন, রাতের বেলায় বস্তায় ভরে কারা কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন,এই তথ্য তাঁর কাছে আছে। সময় এলে বলবেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘যখন জানলাম দুর্নীতি হচ্ছে, তখনই ক্ষতিপূরণের অন্যান্য চেক দেওয়া স্থগিত রেখেছি। এখন টাকা ফেরত আনতে মামলা করা হয়েছে। দুর্নীতির তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি।’