অভিযোগপত্রের তথ্য
লিবিয়া-ইউরোপে মানব পাচারে ১৮ চক্র সক্রিয়
লিবিয়ায় ২০২০ সালে ৩৮ বাংলাদেশি হতাহতের ঘটনায় হওয়া ২৪ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল। মোট আসামি ২৮৮। গ্রেপ্তার ১৫৩।
লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচারের নেটওয়ার্ক ঢাকাসহ দেশের ১৫ জেলায় বিস্তৃত। এতে ১৪ চক্রের তিন শতাধিক সদস্য সক্রিয় আছে। লিবিয়ায় সক্রিয় আছে বাংলাদেশি আরও চারটি চক্র। মোট ১৮টি চক্র মিলে লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচার করছে।
গত বছরের ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানব পাচার চক্রের সদস্যরা জিম্মিদশায় রেখে নির্বিচার গুলি চালিয়ে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে হওয়া ২৫ মামলার তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২৪ মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে। এতে মানব পাচার চক্রের ২৮৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চক্রের ১৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। র্যাব এ মামলাগুলোর ছায়া তদন্ত করে।
অভিবাসন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিআইডি যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে, তাঁরা দালাল কি না দেখতে হবে। তাঁরা যদি দালাল হন, তাহলে মানব পাচার বন্ধ হবে না। তাঁরা বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গিবাদ যেভাবে দমন করা হয়েছে, মানব পাচার প্রতিরোধেও তেমন শক্ত উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই মানব পাচারও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
এদিকে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনা ঘটছেই। গত ২১ জুলাই লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। এর আগে গত ২৪ জুন ভূমধ্যসাগর থেকে ২৬৪ বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। গত ২৮ ও ২৯ জুন নৌকায় অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে ৪৩ জন নিখোঁজ বা মৃত্যু হয়।
মামলাগুলোর তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাচার চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে লিবিয়ায় মানব পাচার করছেন। লিবিয়ায় সক্রিয় কয়েকটি মানব পাচার চক্র ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে ঝুঁকিপূর্ণ মানব পাচার করছে। তিনি বলেন, প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে যাঁরা টাকা ফেরত পান, তাঁরা মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে আগ্রহী হন না। কিছু ব্যক্তি মামলা করলেও মানব পাচারকারীর পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা দেন না।
এই কর্মকর্তা জানান, ২৪ মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত বাকি ১৩৫ মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। বাকি একটি মামলার তদন্তও শেষ পর্যায়ে।
লিবিয়ার মিজদাহ শহরে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কিশোরগঞ্জের যুবক মো. আকাশ। তাঁর ভাই নাজির হোসেন পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ঢাকার মানব পাচারকারী হাজি কামালের মাধ্যমে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে লিবিয়া যান। সেখানে অল্প টাকা বেতন পেতেন। লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের মূল হোতা তানজিদুল ত্রিপোলিতে বেশি বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছ থেকে ৭৫ হাজার টাকা নিলেও সেখানে পাঠাননি।
নাজির হোসেন বলেন, ২০ মে আকাশের কাছ থেকে ভয়েস বার্তায় তিনি জানতে পারেন, ১২ হাজার ডলার মুক্তিপণের জন্য আকাশকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া এবং রড দিয়ে পেটানো হচ্ছে। পরে তিনি তানজিদুলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে আকাশের জন্য তাঁর কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। পরে ২৮ মে গণমাধ্যমে জানতে পারেন মুক্তিপণ না পেয়ে আকাশকে হত্যা করা হয়েছে। এর জন্য তানজিদুলকে দায়ী করেন নাজির হোসেন।
দেশে ১৪ ও লিবিয়ায় ৪ চক্র
তদন্তে উঠে এসেছে, লিবিয়ায় মানব পাচারের সঙ্গে দেশের ১৫ জেলার ১৪ চক্রের তিন শতাধিক ব্যক্তি জড়িত। প্রতিটি চক্রে অন্তত ২৫ জন করে সদস্য সক্রিয় আছেন। মানব পাচার চক্রগুলো ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, বরগুনায় সক্রিয় রয়েছে।
সিআইডি ও র্যাব সূত্র জানায়, রাজধানীতে মানব পাচারে মো. কামালউদ্দিন ওরফে হাজী কামাল (গ্রেপ্তার), খালিদ চৌধুরী, আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে একটি চক্র সক্রিয় আছে। এ ছাড়া মানব পাচারে পুরানা পল্টনের স্কাই ভিউ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের নাম এসেছে। ওই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহীন বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শাহীনের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার কুলপদ্দী গ্রামে।
মাদারীপুরে মানব পাচারে সক্রিয় আছেন নূর হোসেন শেখ, নজরুল, রবি, জুলহাস শেখ, মিরাজ হাওলাদার, রাসেল মীর, রাজন ওরফে বুলেট, মোমিন, ইলিয়াছ মীর, জাকির মিয়াসহ ২৫ জনের একটি চক্র।
গোপালগঞ্জে সক্রিয় আছে রব মোড়লের নেতৃত্বে, কুষ্টিয়ায় মো. কামালের নেতৃত্বে, ফরিদপুরের বক্স সরদারের নেতৃত্বে, নড়াইলে মোক্তার মোল্লার নেতৃত্বে, কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শাওন ও জাফর ইকবালের নেতৃত্বে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রফিকুল ইসলাম (সেলিম) ও হোসাইনের নেতৃত্বে, কুমিল্লার সনাতন দাশ ওরফে দাদা, শরীফ হোসেনের নেতৃত্বে, শরীয়তপুরের রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে, বরগুনায় সজল ও ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে, নোয়াখালীতে রুবেল মির্জা, নাসির উদ্দিন মির্জা ও রিপন মির্জার নেতৃত্বে একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। হেলাল মিয়া, খবির উদ্দিন ও শহিদ মিয়ার নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে।
আশিকের নেতৃত্বে একটি চক্র মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানব পাচারে সক্রিয় আছে। র্যাব জানায়, আশিকের (২৫) বাড়ি কেরানীগঞ্জের পার গেন্ডারিয়ায়। তিনি এসএসসি পাস। ২০১৯ সালে কেরানীগঞ্জে অবস্থান করে মানব পাচারে যুক্ত হন। ২০ থেকে ২৫ জনের একটি মানব পাচার চক্র গড়ে তোলেন। আশিকের পাচারকারী চক্রে রয়েছেন মামি সিমা আক্তার, খালা হেলেনা বেগম ও পলি আক্তার। গত ১০ জুলাই রাতে পুলিশ আশিককে গ্রেপ্তার করে। দুবাইয়ে অবস্থান করে লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচারকারী তিন চক্রের (গাজী, কাজী ও বাবুল) মূল হোতা রুবেল মিয়া হলেন আশিকের মামা। রুবেলের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড় ভাটারায়।
গাজী, কাজী, বাবুল চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে চাকরিপ্রত্যাশীদের ইউরোপের ইতালিতে নেওয়ার জন্য সাত-আট লাখ টাকা করে নেন। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের প্রথমে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তিন থেকে চার লাখ টাকা নেওয়া হয়।
র্যাব জানায়, গত দুই বছরে মামা রুবেল ও ভাগনে আশিক চক্র ৮০ জনকে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মাদারীপুরের নিখোঁজ দুজনের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব অনুসন্ধান চালিয়ে এই পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায়। তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে ৮ লাখ করে ১৬ লাখ টাকা নেওয়া হয়। লিবিয়ার মিজদাহে হতাহত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে আশিক চক্র সে দেশে পাচার করেছিল।
লিবিয়ায় তানজিলুর ওরফে তানজিমুল ওরফে তানজি ও আবদুল্লাহর নেতৃত্বে আরেকটি চক্র সক্রিয় আছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তথ্য যাচাই–বাছাই না করে সহজ উপায়ে লিবিয়া ও ইউরোপ যেতে গিয়ে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, সারা দেশে মানব পাচারে সহস্রাধিক ব্যক্তি জড়িত।
‘দালাল ধরা পড়লে মানব পাচার বন্ধ হবে না’
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গিবাদ যেভাবে দমন করা হয়েছে, মানব পাচার প্রতিরোধে তেমন শক্ত উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই মানব পাচার নিয়ন্ত্রণে আসবে। মানব পাচারের ঘটনায় সাধারণত দালাল ধরা পড়ে। দালাল ধরা পড়লে মানব পাচার বন্ধ হবে না। তাঁদের মাধ্যমে পাচারকারীর মূল ঘাঁটিতে পৌঁছাতে হবে। পুলিশ যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে, তাঁরা দালাল কি না দেখতে হবে। তাঁরা যদি দালাল হন, তাহলে মানব পাচার বন্ধ হবে না।
তাসনিম সিদ্দিক বলেন, মানব পাচারের বিরুদ্ধে নাটক নির্মাণ করতে হবে। এসব নাটক গণমাধ্যম, বিশেষ করে রেডিও ও সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচার করতে হবে। এতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে। শূন্য সহনশীলতা নীতি (জিরো টলারেন্স) অবলম্বন করলে মানব পাচার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়া মানব পাচার অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলাগুলোর বিচার করলে পাচারকারীরা ভয় পেতে পারেন।