রাজবাড়ীতে ১৪ দিনে ৪ হত্যা নিয়ে আতঙ্ক

রাজবাড়ীতে ১৪ দিনের ব্যবধানে চার নারী ও শিশুর গলাকাটা লাশ উদ্ধারের ঘটনায় স্থানীয় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, এ জন্য লোকজন রাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করেছে।

গত ১৬ আগস্ট রাতে রাজবাড়ী সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের বারবাকপুর গ্রামে পুত্রবধূ ও নাতির সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন হাজেরা বেগম। দুর্বৃত্তরা ওই বাড়িতে হামলা চালিয়ে হাজেরা বেগমকে গলা কেটে হত্যা করে। দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন পুত্রবধূ ও নাতি।

এ ঘটনায় হাজেরার স্বামী তমিজ উদ্দিন শেখ বাদী হয়ে মামলা করলেও হত্যারহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ড ঘিরে নানান গুজব দানা বেঁধে উঠেছে। গুজবে ঘিয়ে আগুন দিচ্ছে পেছনের আরও তিনটি হত্যাকাণ্ড।

এলাকাবাসীর ক্ষোভ, মাত্র ১৪ দিনে চার নারী ও শিশুকে গলা কেটে হত্যা করা হলেও পুলিশ একটি ছাড়া বাকি হত্যাকাণ্ডের কারণ উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি। পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যর্থতায় এলাকায় বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছে। আরও নারী ও শিশু হত্যার শিকার হতে পারে—এমন আশঙ্কায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। লোকজন রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে।

পুলিশ ও প্রশাসন বলছে, গুজব বন্ধে তারা প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মসজিদের ইমাম ও কমিউনিটি পুলিশকে প্রচার চালাতে অনুরোধ করেছে। এর মধ্যে তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। এলাকায় এলাকায় পুলিশের টহলও বাড়ানো হয়েছে।

হত্যার ঘটনাগুলো থেকে জানা যায়, রাজবাড়ীতে ১৪ দিনের ব্যবধানে চার নারী ও শিশুর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সবাইকে রাতে ঘরে ঢুকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

গত ৩ আগস্ট রাজবাড়ী সদর উপজেলার মূলঘর ইউনিয়নের পশ্চিম মূলঘর গ্রামে দাদি সাহিদা বেগম (৫০) ও নাতনি লামিয়া আক্তারের (৭) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাহিদার ছেলে শহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করে।

দাদি ও নাতনিকে হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই বানিবহ ইউনিয়নের আটদাপুনিয়া গ্রামে আদুরি বেগম নামের এক গৃহবধূকে ৭ আগস্ট গলা কেটে হত্যা করা হয়। আদুরির স্বামী মিজানুর রহমান পেশায় রডমিস্ত্রি। তিনি কক্সবাজারের উখিয়ায় কাজ করেন। মিজানুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এরপর সর্বশেষ ১৬ আগস্ট সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের বারবাকপুর গ্রামে হাজেরা বেগমের (৫২) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়।

এসব ঘটনায় একমাত্র আদুরি বেগম হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটন করা গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশের দাবি, পিলার থেকে ম্যাগনেট সংগ্রহ চক্রের সদস্য ছিলেন আদুরি বেগম। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

এসব হত্যার পর এলাকায় গুজব রটেছে, বিশেষ উদ্দেশে নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। শুরুতে পুলিশ বিষয়টি আমল না দেওয়ায় গুজব ডালপালা মেলে আরও ছড়িয়ে যায়।

পশ্চিম মূলঘর গ্রামের বাসিন্দা মান্নান মোল্লা বলেন, এলাকার অবস্থা খুব খারাপ। যাদের কাঁচা বাড়ি, সন্ধ্যার আগেই তাঁরা প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। কয়েক বাড়ির লোকজন একসঙ্গে ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য পুলিশ বের করতে পারলে এত গুজব ছড়াত না। তাঁর মতে, হত্যাকাণ্ডের রহস্য বের করতে পারলেই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাটবে।

বারবাকপুর গ্রামের বাসিন্দা চা দোকানদার কাজল খান বলেন, ‘অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে এতগুলো হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এসব খুনের রহস্য আমরা কেউ জানতে পারিনি। এতে সবার মধ্যে ভয় দেখা দিয়েছে। সন্ধ্যার পর দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। নারীরা রাতে কেউ ঘর থেকে বের হন না। আমরা চাই, অবিলম্বে খুনের রহস্য বের করা হোক। আমাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া হোক। নিরাপত্তার জন্য কয়েক গ্রামের মানুষ রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। পুলিশও রাতে এলাকায় টহল দিতে আসে।’

পশ্চিম মূলঘরের আরেক বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মামি ও মামাতো ভাইয়ের মেয়েকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। এরপর আরও দুজনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। এতে এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয় লোকজন রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। পুলিশও টহল দিয়ে সহযোগিতা করছে। কী কারণে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তা জানতে পারিনি।’

মূলঘর ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান মুসল্লি বলেন, এমনভাবে গুজব ছড়াচ্ছে যে মানুষ বিশ্বাস করে ফেলছে। আতঙ্কে স্থানীয় লোকজন পাহারা দেওয়া শুরু করেছে। পুলিশও তাদের টহল বাড়িয়েছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, বারবাকপুর, হোগলাডাঙ্গী, কোমরপাড়া, ইন্দ্রনারায়ণপুর, আলাদীপুর, কালি চাঁদপুর, পশ্চিম মূলঘর, রামপুর, চর আলাদীপুর—এসব গ্রামে রাত জেগে পাহারা দেওয়া হচ্ছে।

রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাকিব খান প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য বের করতে পুলিশ তৎপর। কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে হত্যাকাণ্ডের রহস্য বের করার কাজ চলছে। দোষী ব্যক্তিরা যাতে পার না পায়, আবার নির্দোষ ব্যক্তি যাতে বিপদে না পড়ে, তা খেয়াল রাখা হচ্ছে। আশা করা যায়, দ্রুত সময়ের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের রহস্য বের করা যাবে।

গুজবের বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘গুজব তো গুজবই। গুজবে কান না দিতে এলাকার লোকজনকে সচেতন করার জন্য জনপ্রতিনিধি ও মসজিদের ইমামদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মসজিদের ইমামদের বলা হয়েছে, নামাজের পর খুতবায় তাঁরা যেন গুজব কান না দিতে লোকজনকে অনুরোধ জানান। এ ছাড়া কমিউনিটি পুলিশকেও এ সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর কাজে নামানো হয়েছে।’ এলাকায় পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

একই কথা জানালেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাঈদুজ্জামান খান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জেলায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির গত বৈঠকে গুজবের বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। গুজবে কান না দিতে এবং আতঙ্কিত না হতে এলাকার লোকজনকে সচেতন করার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে প্রচার চালাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।