‘যা কিছু ঘটে, পুলিশ বলে কেষ্টনি বেটিই চোর’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখন বেঁচে থাকলে মোটেই লিখতেন না যে, ‘যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর!’ বরং তিনি লিখতেন, ‘যা কিছু ঘটে, পুলিশ বলে কেষ্টনি বেটিই চোর’। যারা আমার সঙ্গে একমত নন, তারা কক্সবাজারের সাম্প্রতিক দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন।
কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে সব সময়ই এর দুটি পক্ষ থাকে। এক পক্ষ ভুক্তভোগী, আরেক পক্ষ অভিযুক্ত। নিয়ম হচ্ছে, ভুক্তভোগী প্রতিকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা প্রশাসনের কাছে যাবেন, আর অভিযুক্তকে দ্রুত ধরা হবে। কিন্তু আমাদের এখানে অভিযুক্ত পালিয়ে থাকবেন, তাকে বা তাদের সহজে পাওয়া যাবে না। তাহলে হাতে থাকল ভুক্তভোগী। এখন সেই ভুক্তভোগী যদি নারী হন, তাহলে তো কথাই নেই। এ ক্ষেত্রে সব দোষ এই ‘কেষ্টনি বেটিরই’।
কক্সবাজারের ঘটনার দিকে এবার আসা যাক। ঘটনাটি ২২ ডিসেম্বরের। ওই রাতে কক্সবাজারে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এক নারীর স্বামী বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেছিলেন। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম ও পরিচয়ও ছিল। সেই নারী সাহায্য চেয়ে ৯৯৯-এ সহায়তা চেয়েও পাননি। পরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন তাঁকে উদ্ধার করে। সাম্প্রতিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে র্যাবের এই মানবিক কাজ বনাম পুলিশের ভূমিকা নিয়ে পরে কোনো একসময় আলোচনা করা যেতে পারে।
আমরা বরং ২২ ডিসেম্বর পরবর্তী চার দিনের ঘটনার দিকে তাকানো যাক। ঘটনার প্রধান আসামি মো. আশিক স্থানীয় সন্ত্রাসী হিসেবেই পরিচিত। সহযোগীসহ তাঁর পূর্ণ পরিচয় সবারই জানা ছিল। তবে প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তারের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট সবার আগ্রহ যেন বেশি ছিল অভিযুক্ত নারীর প্রতিই। সেই নারী কতবার কক্সবাজারে এসেছেন, কয় মাস আগে ৯৯৯-এ ফোন করেছিলেন, আসলে বিশেষ এক পেশার কারণে তিনি কক্সবাজারের বারবার আসেন—এসব কথাই বারবার আলোচনায় আসছিল।
আর ওই চার দিন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টের কাছে ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যালয়ে তিনতলার একটি কক্ষে চার দিন ধরে অনেকটা ‘বন্দিজীবন’ কাটিয়েছেন সেই নারী। সঙ্গে ছিলেন আট মাস বয়সী সন্তান ও তাঁর স্বামী। ধরে নেওয়া গেল নিরাপত্তার কারণে এই ‘বন্দিজীবন’। এর মধ্যেই আবার গত শুক্রবার ওই নারী আদালতে জবানবন্দিও দেন। আর প্রধান আসামি ধরা পড়ে গত রোববার রাতে।
টানা চার দিন ট্যুরিস্ট পুলিশের হেফাজতে ‘বন্দিদশা’ থেকে মুক্তি পেয়ে রোববার রাতে ঢাকায় ফিরেছেন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর স্বামী-সন্তান। আর এখন তিনি ও তাঁর স্বামী বলছেন, ‘পুলিশের তদন্তে তাঁর আস্থা নেই। দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার যেন সুষ্ঠু তদন্ত হয়, এর জন্য তাঁরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চান। আর কয়েক দিন নানা চাপের মধ্যে তাঁর স্ত্রীকে ওল্টোপাল্টা বক্তব্য দিতে হয়েছে। জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে কক্সবাজার আদালতে মিথ্যা জবানবন্দিও দিতে হয়েছে।’
প্রথম প্রশ্ন ভুক্তভোগীদের বন্দিজীবন নিয়ে। এরপরেই আসবে আদালতে শেখানো বুলির প্রসঙ্গটি। এর মধ্যেই আছে ওই নারীকে নিয়ে নানা ধরনের প্রচার। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, ভুক্তভোগীরা বলছেন যে পুলিশের তদন্তে তাঁদের আস্থা নেই। আর পাঠক ও সাংবাদিক হিসেবেও আমরাও দেখেছি, চার দিনে কীভাবে ওই নারীর কথিত কর্মকাণ্ডকেই বেশি বেশি প্রচার করা হয়েছে, যাতে মনে হয়, সব দোষ তাঁরই।
এর আগেও দেখা গেছে, পরীমনি যখন মামলা করলেন, তখন তাঁর নানা কর্মকাণ্ড নিয়েই আলোচনা বেশি। পরীমনিকে আটক করার যে অভিযান, তা–ও বড় কোনো এক সন্ত্রাসী বাহিনী আটক অভিযানের তুলনায় কম ছিল না। এমনকি মুনিয়া মরে গিয়েও রেহাই পাননি, সব দোষ যেন তাঁরই। আবার কথিত মডেলদের গ্রেপ্তারের পরে ফোনালাপ, এমনকি নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ক্লিপ যখন ফাঁস করা হয়, তখনো মনে হয়, নির্দিষ্ট কিছু ‘কেষ্ট বেটা বা কেস্টুনি বেটিই’ কেবল চোর। বাকি সবাই সাধু।
ভালো কথা, চার দিন আগেই আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক অনুষ্ঠানের কারণে মনে পড়ল যে আমাদের একটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আছে। ভুক্তভোগীর বন্দিজীবন বা শেখানো বুলি, একতরফা প্রচার—এসব মনে হয় তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।