কক্সবাজারে সরকারের তিন লাখ কোটি টাকার ৭২টি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের শুরুতেই ভূমি অধিগ্রহণে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতার সহায়তায় দুর্নীতির এ জাল বিস্তারের তথ্য পাওয়া গেছে।
কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কিছু কর্মকর্তার নামও এ চক্রে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেন। এতে আমলা, রাজনীতিকসহ ১৫৫ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিনটি তদন্ত প্রতিবেদনে তিনটি প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে মোট ৭৮ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে তছরুপ হয়েছে প্রায় ৫৯ কোটি টাকা।
তিনটি প্রকল্পের ওই দুর্নীতির প্রতিবেদন গত ৩০ জুন দুদকের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। দুদক থেকে ওই তদন্তের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এত দিনেও। উল্টো ওই তিনটি তদন্ত বাতিল করে পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ দুর্নীতির তদন্তে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তা দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে প্রথমে বদলি এবং পরে গত বুধবার চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি তাঁকে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে ১৯টি অভিযোগ দিয়েছেন।
শুধু কক্সবাজারে নয়, দেশের যেখানেই সরকারি প্রকল্প হচ্ছে, তার আগাম খবর কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি আগেভাগে জেনে যাচ্ছে। তারা ওই জমি কম দামে কিনে সরকারের কাছে বেশি দামে বিক্রির মধ্য দিয়ে লাভবান হচ্ছে।
দুদকের প্রতিবেদনে ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির সঙ্গে ১৫৫ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁদের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগের কক্সবাজারের স্থানীয় নেতা-কর্মী। এতে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন ওই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
শরীফ উদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কক্সবাজারের কয়েকটি মেগা প্রকল্পের দুর্নীতি অনুসন্ধানে আমি সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা ও একটি দালাল চক্রের রোষানলে পড়ি। তারা আমাকে তাদের নাম তদন্তে না দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু দুর্নীতির প্রমাণ থাকায় আমি তাতে সম্মত হইনি। তাদের হত্যার হুমকিতে আমি জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত আছি। ’
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় কয়েকটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, মূলত ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে তদন্তে প্রাথমিকভাবে সরকারের একজন প্রভাবশালী সচিবের নাম আসে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়। রাখা হয় কক্সবাজারের সাবেক ডিসি কামাল হোসেন, পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানসহ ১৫৫ জনের নাম।
দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা প্রকল্প তিনটি হলো
কক্সবাজার পৌরসভার পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প, কক্সবাজার শহরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কক্সবাজার কার্যালয় নির্মাণ এবং মহেশখালীতে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) নির্মাণ প্রকল্প। ২০১৮ সাল থেকে এসব প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়।
ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে আমাদের এখানে সব সময়েই একটি দুষ্টচক্র কাজ করে। এ চক্রের কারণে প্রকৃত ভূমিমালিকেরা ক্ষতিপূরণের অর্থ থেকে বঞ্চিত হয়। ওই চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ ধরনের দুর্নীতির লাগাম টানা যাবে নাদুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান
প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনটি প্রকল্পেই জমির ক্ষতিপূরণের টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি দালাল চক্র সক্রিয় ছিল। তারা ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ কমিশন হিসেবে নিত, যা দালাল চক্রের হাত দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সরকারি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো।
জানতে চাইলে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে আমাদের এখানে সব সময়েই একটি দুষ্টচক্র কাজ করে। এ চক্রের কারণে প্রকৃত ভূমিমালিকেরা ক্ষতিপূরণের অর্থ থেকে বঞ্চিত হয়। ওই চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ ধরনের দুর্নীতির লাগাম টানা যাবে না। ’
চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতে এই প্রতিবেদক সরেজমিনে ওই তিন প্রকল্পের নির্মাণকাজ দেখতে যান। দেখা যায়, চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘিরে এসব অবকাঠামোর নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে চলছে। কিন্তু এখনো ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বেশির ভাগ জমির মূল মালিক।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের বর্তমান জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে ওই দুর্নীতির অভিযোগগুলো উঠেছিল। জেলা প্রশাসন থেকে তখন যে তদন্ত হয়েছে, তার প্রতিবেদনও আমি আসার আগে দেওয়া হয়েছে। ফলে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আর এ নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তদন্ত করছে বলে শুনেছি। তারা সহযোগিতা চাইলে আমরা দেব।
কেঁচো খুঁড়তে সাপ
২০২০ সালে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার খবরের ভিত্তিতে কক্সবাজার শহরের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। সেখানে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খানকে গ্রেপ্তার করে তারা। বাসায় পাওয়া যায় ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পরে আরও দুই দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুধু নগদ টাকা নয়, ওই বাসায় পাওয়া যায় এ তিন প্রকল্পের সরকারি ভূমিসংক্রান্ত সাত বস্তা নথি।
এতে ছিল জমি অধিগ্রহণের জন্য দেওয়া ক্ষতিপূরণের চেক, জমির মালিকদের করা আবেদন ও ভূমিসংক্রান্ত অন্যান্য নথি। ওই নথির সূত্র ধরেই দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনের নেতৃত্বে তিনটি আলাদা প্রকল্প নিয়ে তদন্ত হয়। ওই তিন তদন্ত প্রতিবেদনে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে দুর্নীতির জাল বিস্তারের তথ্য উঠে আসে। গ্রেপ্তার হওয়া ওই তিনজনের দেওয়া জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে ওই চক্রের সঙ্গে থাকা অন্যদের নাম।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে কক্সবাজার থেকে দোহাজারী রেললাইন প্রকল্প, মাতারবাড়ী ১ হাজার ২১২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মগনামা পেকুয়া নৌবাহিনী ঘাঁটি প্রকল্প এবং কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রকল্পেও ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
দুর্নীতিতে মেয়রসহ মহারথীদের নাম
তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতির জন্য পৃথক তিনটি মামলা করে দুদক। তদন্তকারী কর্মকর্তার ৭৫০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ২৩ পদস্থ কর্মকর্তাসহ মোট ৪৪ জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। এতে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, সাবেক জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফসারসহ ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়।
এ ছাড়া দুদকের তালিকায় দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে সাতজন রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে, যাঁদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান এবং তাঁর ছেলে হাসান মেহেদি রহমান, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসেদুল হক (রাশেদ), মহেশখালী উপজেলার কালামারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান (শরীফ) এবং কক্সবাজার যুবদলের সভাপতি শরীফুল ইসলাম।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে কক্সবাজারের পাঁচজন সাংবাদিক, আটজন আইনজীবী, দুজন ব্যাংকারের নাম উঠে আসে, যাঁরা কোনো না কোনোভাবে ওই দুর্নীতি ও দালাল চক্রের অংশ হিসেবে কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, তাঁরা সবাই সরকারি অর্থ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের না দিয়ে আত্মসাৎ করতে ভূমিকা রেখেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন দাবি করেন, স্থানীয় পর্যায়ে ভূমি অধিগ্রহণ কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি থাকলেও মূলত কাজটি মাঠপর্যায়ে সার্ভেয়াররা করে থাকেন। তাঁদের দেওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তিনি অনুমোদন দেন। তাঁর ভাষ্য, ‘জেলা প্রশাসন থেকে আমরা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করে দেখেছি। কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ’
মেয়র পরিবারের স্বার্থে জমি কেনায় বাড়তি ব্যয়
২০১৫ সালে কক্সবাজার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সরওয়ার কামাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাছে পানি শোধনাগার প্রকল্পের জন্য দুটি সম্ভাব্য জায়গার প্রস্তাব করেন। এর মধ্যে শহরের পিএমখালী এলাকায় অধিগ্রহণে সম্ভাব্য খরচ ধরা হয় ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আর সরকারের খাস খতিয়ানে থাকা ঝিলংজা মৌজায় অধিগ্রহণে খরচ ১১ কোটি টাকা হতে পারে উল্লেখ করে কম খরচ হবে, এমন জায়গায় পরিশোধনকেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করা হয়।
দুদকের তদন্তে বলা হয়, কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান পানি শোধনাগার নির্মাণের জন্য ঝিলংজা মৌজায় ২ দশমিক ৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করার প্রস্তাব সমর্থন করেন। এর মধ্যে ১ দশমিক ৭১ একর জমি নেওয়া হয় মেয়র মুজিবুর রহমানের স্ত্রী ও স্ত্রীর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে। এ জন্য তাঁরা প্রায় ৩০ কোটি টাকা পাচ্ছেন।
ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী, প্রস্তাবিত ভূমিকে ঘিরে কোনো আইনি জটিলতা আছে কি না, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার তা যাচাই-বাছাই করার নিয়ম রয়েছে। তদন্তে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার ও কক্সবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বিকল্প স্থান অনুসন্ধান করেননি। ওই ভূমি নিয়ে যে আইনি জটিলতা আছে, তা-ও আড়াল করে ভূমিটি অধিগ্রহণ করেছেন।
শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালে জমিটি অধিগ্রহণ করার কয়েক মাস আগে জমিটি মেয়রের স্ত্রী ও স্ত্রীর বড় ভাইয়ের নামে নিবন্ধন ও নামজারি শেষ করা হয়। ঝিলংজা মৌজার মোট ২ দশমিক ৭৫ একর জমি ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকায় অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১৮ সালে মুজিবুর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরপরই তিনি স্ত্রী ও স্ত্রীর বড় ভাইয়ের নামে সেখানে ১ দশমিক ৭১ একর জমি কেনেন। তারপর তিনি প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে পাশ কাটিয়ে নিজেই ওই প্রকল্পের জন্য সুপারিশ করেন। জেলা প্রশাসক ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য সম্মতি দেন।
দুদকের তদন্তে বলা হয়, বাঁকখালী নদীর অন্য পারে আরও দুটি বিকল্প জায়গায় ওই প্রকল্প করা যেত। সেখানে জমির দাম ১ কোটি ১১ লাখ এবং ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা হতো। কিন্তু তা না করে ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে মেয়রের আত্মীয়দের জমি কেনা হয়। এর মধ্যে মেয়রের স্ত্রীর বড় ভাইসহ কয়েকজনের নামে সাড়ে সাত কোটি টাকার চেক দেওয়া হয়েছে। আর মেয়রের স্ত্রীর নামে ২২ কোটি টাকার চেক দেওয়ার কাজ প্রক্রিয়াধীন।
মেয়রের স্ত্রীর বড় ভাই মিজানুর রহমান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘আমার জমিতে পানি শোধনাগার নির্মাণের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। সরকার তা অধিগ্রহণ করেছে, আমাকে টাকাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো প্রভাব কাজ করেনি। ’
এ ব্যাপারে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও মেয়র মুজিবুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নিয়ম ভেঙে মেয়রের স্ত্রীকে সার্কিট হাউসে চেক হস্তান্তর
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১১ জুলাই কক্সবাজার সার্কিট হাউসে পানি শোধনাগারের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তির সাড়ে সাত কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করেন স্থানীয় সরকারসচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ আইনের ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যথাসম্ভব মাঠপর্যায়ে যাইয়া প্রকাশ্যে চেক হস্তান্তর করতে হবে। ’ সাধারণত এর আগের ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রায় সব চেক জেলা ভূমি কার্যালয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়রের স্ত্রীর বড় ভাই মিজানুর রহমানের চেক প্রদানের স্থান হিসেবেও হিলটপ সার্কিট হাউসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বা কোনো একজন আইনজীবী চেক গ্রহণকারী ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিককে চিহ্নিত করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চেকে মেয়র মুজিব নিজেই তাঁর স্ত্রীর বড় ভাইকে চিহ্নিত করে স্বাক্ষর করেন। নিয়ম অনুযায়ী যেদিন চেক গ্রহণ করা হবে, সেই দিন স্বাক্ষরগুলো একসঙ্গে দিতে হবে। কিন্তু মেয়র মুজিবুর স্বাক্ষর করেন ৯ জুলাই আর তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই ওই চেক গ্রহণের স্বাক্ষর দেন ১১ জুলাই।
এ ব্যাপারে ওই সময়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা শামীম হুসাইন প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব উপস্থিত ছিলেন, সেখানে নিয়ম না মেনে কোনো কিছু করা হবে, এটা হতে পারে না।
ভুয়া মালিকের জমিতে পিবিআই ও সিআইডির কার্যালয়
পিবিআই ও সিআইডি কক্সবাজার কার্যালয়ের ভবনের জন্য সমুদ্রসৈকত-সংলগ্ন কলাতলীতে ২৯ কোটি টাকায় ১০০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে জেলা প্রশাসন। দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে, ওই অধিগ্রহণ সঠিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। নিয়ম মেনে জমি অধিগ্রহণ করলে খরচ হতো ১৭ কোটি টাকার চেয়ে কিছু বেশি। আশির দশকে সরকারের আরেকটি সংস্থা ওই ভূমির অংশবিশেষ অধিগ্রহণ করেছিল। সেই জমি সরকারি টাকা ব্যয়ে আবারও অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
তদন্তে বলা হয়, ১৫ জনকে ভুয়া মালিক সাজিয়ে ওই চক্র ২৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, যাঁরা নিজেদের মধ্যে ওই টাকা ভাগাভাগি করেছেন। আর ওই চক্রের নেতৃত্ব রয়েছেন মো. ইদ্রিস, বেলায়েত হোসেন ও নুরুল হক।
দুদকের তদন্তে পিবিআই কক্সবাজার কার্যালয় নির্মাণের শুরুতে ইউনিট প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মো. মনিরুজ্জামান। তাঁকে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে আসামি করার সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলার পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান। অভিযোগের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওই প্রকল্প শুরু হওয়ার সময়ে দায়িত্বে ছিলাম। পরে আমি সেখান থেকে বদলি হওয়ার পর জমির অর্থ পরিশোধের কাজ হয়েছে। এ তদন্তে আমার নাম কীভাবে এল? ’
এ ছাড়া মহেশখালীতে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও ভূমি অধিগ্রহণে একই ধরনের দুর্নীতি হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকল্পের কার্যালয় স্থাপন এবং নির্মাণ উপকরণ রাখার জন্য কালারমারছড়া ইউনিয়নের ১৪৪ একর কৃষিজমি তিন বছরের জন্য হুকুমদখল করা হয়। দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে, একদল ভুয়া মালিকের নামে ক্ষতিপূরণের চেক ইস্যু করা হয়। তাঁরা ২০১৮ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়ে যান। পরে এ ঘটনায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিমালিকেরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও এবং মানববন্ধন করেন।
সরকারের এ ধরনের বড় প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, শুধু কক্সবাজারে নয়, দেশের যেখানেই সরকারি প্রকল্প হচ্ছে, তার আগাম খবর কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি আগেভাগে জেনে যাচ্ছেন। তাঁরা ওই জমি কম দামে কিনে সরকারের কাছে বেশি দামে বিক্রির মধ্য দিয়ে লাভবান হচ্ছেন।
দুর্নীতির তদন্ত করে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতি প্রসঙ্গে শাহদীন মালিক বলেন, দুদকের কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন বড় বড় প্রকল্পের দুর্নীতির তদন্ত করেছেন। তাতে বড় বড় মানুষকে অভিযুক্তের তালিকায় এনেছেন তিনি। এতে জনমনে এ ধারণা তৈরি হয়েছে, তিনি (শরীফ উদ্দিন) একজন সৎ ও সাহসী কর্মকর্তা। হঠাৎ করে তাঁকে অপসারণ করায় দুদক সম্পর্কে অনাস্থা তৈরি হবে এবং মনে হবে দুদক কেবল চুনোপুঁটিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। রুই-কাতলারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। না হলে রাষ্ট্রের প্রতিও মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হবে।