বিবাদের নতুন ক্ষেত্র বান্দরবান, নেপথ্যে চাঁদাবাজি
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির গৃহদাহের আগুন অবশেষে অপর পার্বত্য জেলা বান্দরবানেও ছড়িয়ে পড়েছে। জেলাটিতে এত দিন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস ছাড়া অন্য আঞ্চলিক দলের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। মার্চে চট্টগ্রামে বসে জেএসএস-এম এন লারমার বান্দরবান জেলা কমিটি গঠন করা হয়। এরপর থেকেই আধিপত্য নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয় সক্রিয় অবস্থানে থাকা জেএসএসের সঙ্গে। সেটা শেষ পর্যন্ত সংঘাতে গড়াল। মঙ্গলবারের হামলায় এম এন লারমার ছয়জন খুন হন।
পাহাড়ে এলাকাভিত্তিক এসব আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মূলে চাঁদাবাজি একটা বড় কারণ বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। এ ছাড়া এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখাসহ নানা কারণ রয়েছে। আধিপত্যের পেছনে চাঁদাবাজি বলা হলেও আঞ্চলিক দলগুলোতে অপরাধের বিস্তার ঘটানোও সংঘাতের একটা বড় কারণ বলে কেউ কেউ মনে করেন।
বান্দরবানে দুই বছর ধরে জেএসএসের পাশাপাশি ‘মগ পার্টি’ নামে একটি গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য চলছিল। আধিপত্যের জের ধরে কখনো মগ পার্টির, কখনোবা জেএসএস নেতা-কর্মীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। আবার মগ পার্টিকে আশ্রয় দেওয়া কিংবা আধিপত্যে ব্যাঘাত ঘটানোর অভিযোগে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও খুন হন। জেএসএস-লারমার কমিটি গঠনের পর মগ পার্টির কিছু সদস্য এই দলে ভেড়েন। এখন সংঘাতের নতুন মেরুকরণ জেএসএস বনাম জেএসএস-এম এন লারমা।
বান্দরবান সদর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ে সক্রিয় গ্রুপগুলোর মধ্যে জেএসএস, জেএসএস-লারমা, ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এবং সাম্প্রতিক সময়ে মগ পার্টির নাম শোনা যায়। আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার পেছনে বড় একটা কারণ এলাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ। এর কারণে খুনোখুনি হয়। সর্বশেষ ঘটনাও একই কারণে। সংঘাতের সঙ্গে কারা জড়িত, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
নেপথ্যে চাঁদাবাজি
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ৩১ মে বান্দরবানের বাঘমারা এলাকায় জেএসএস-লারমার নেতারা দলবল নিয়ে ঢোকেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল খাগড়াছড়ির কিছু বহিরাগত। বাঘমারা বাজারে তাঁরা অফিস নিয়ে থাকতেন। খাওয়াদাওয়া করতেন জেলা সভাপতি রতন তঞ্চঙ্গ্যার বাড়ির উঠানে। পাশে দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক উবামং মারমার ঘর। তাঁরা প্রকাশ্যে মহড়া দিতেন বলে অভিযোগ।
কিন্তু নিজেদের অধ্যুষিত এলাকায় বহিরাগতদের আগমন ও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ভালোভাবে নেয়নি জেএসএস। এ ছাড়া এলাকার লোকজনও ভয়ে ছিল। এর জের ধরে মঙ্গলবার অতর্কিত হামলা হয় জেএসএস-লারমার নেতা-কর্মীদের ওপর।
জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মো. ইসলাম বেবী প্রথম আলোকে বলেন, এ হত্যাকাণ্ড পুরোপুরি সন্তু গ্রুপ ও জেএসএস-লারমার মধ্যে হয়েছে। এসব আধিপত্যের চেষ্টার মূলে রয়েছে চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাও খুন হন জেএসএসের হাতে। পাহাড়ের কাঠ বা ফল ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষের কাছ থেকে চাঁদা নেয় তারা। মগ পার্টিও এসব কাজে রয়েছে।
চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে জেএসএস-লারমার সাধারণ সম্পাদক উবামং মারমা বলেন, ‘আমরা কোনো অপরাধ বা চাঁদাবাজিতে জড়িত নই। জেএসএস আমাদের ওপর হামলা করেছে। নতুন কমিটি গঠনের অধিকার সবার আছে। খাগড়াছড়ি থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা-কর্মী।’
সদ্য নিহত সভাপতি রতন তঞ্চঙ্গ্যার স্ত্রী মেনি মারমা জানান, তাঁর স্বামী কিছু করতেন না। শুধু পার্টি করে তাঁদের সংসার চলত।
চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে জেলা জেএসএসের সাধারণ সম্পাদক ক্যাবা মংকে ফোন করে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মঙ্গলবার তিনি হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করেছেন।
১০ জনের নামে মামলা
বান্দরবানের রাজবিলা ইউনিয়নের বাঘমারা বাজারপাড়ায় জেএসএস-লারমা দলের ছয় নেতা–কর্মী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল বান্দরবান সদর থানায় মামলা হয়েছে। দলের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক উবামং মারমা বাদী হয়ে গতকাল ১০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০ জনের নামে মামলা করেছেন। তবে পুলিশ গণমাধ্যমের কাছে আসামিদের নাম উল্লেখ করতে রাজি হয়নি।
এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
মঙ্গলবারের ঘটনায় নিহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন খাগড়াছড়ির বাসিন্দা। গতকাল তাঁদের কোনো আত্মীয়স্বজন লাশ নেওয়ার জন্য বান্দরবান যাননি। এতে লাশ হস্তান্তরে জটিলতা দেখা দেয়। পরে জেএসএস-লারমা নেতা উবামং মারমা ও রাঙামাটি থেকে আসা দুজনের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। তাঁরা খাগড়াছড়ি জেলা সদর পর্যন্ত নিয়ে সেখানে আত্মীয়স্বজনের কাছে তুলে দেবেন বলে জানিয়েছেন। নিহত রতন তঞ্চঙ্গ্যার স্ত্রী, ছেলে, আত্মীয়রা সারা দিন হাসপাতালের সামনে বসে ছিলেন। সন্ধ্যায় তাঁদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়।
বাঘমারা বাজারপাড়ার লোকজন জানিয়েছেন, ঘটনার পর বাঘমারা বাজারসহ পুরো এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ এলাকার বাইরে গিয়ে রয়েছেন। নিহত রতন তঞ্চঙ্গ্যার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, দলের ভেতরে সমস্যা রয়েছে। ভেতরের সব তথ্য জেএসএসের কাছে প্রতি মুহূর্তে সরবরাহ করায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হয়েছে।
উবামং মারমা জানান, হত্যাকাণ্ডের পর বাঘমারা বাজার ও বাজারপাড়ায় আপাতত দলীয় কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
বান্দরবান সদর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, হত্যাকারীদের শনাক্ত করা, কীভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটল, কারা কারা জড়িত থাকতে পারে, এসব বিষয় মাথায় নিয়ে ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে এম এন লারমা দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এ ঘটনা ঘটার বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ দলের ভেতরে কেউ জড়িত না থাকলে এত বড় ঘটনা ঘটানো সহজ নয়।
বান্দরবানে সংঘাতের পূর্বাপর
বান্দরবানে রাজবিলা ইউনিয়নের তাইংখালী বাজারে গত বছরের ১৪ এপ্রিল প্রথম মগ পার্টি জেএসএস-সমর্থক অংক্য থোয়াই মারমাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। এরপর ৭ মে জেএসএস কর্মী বিনয় তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ বছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত গুলিতে জেএসএসের তিনজন, আওয়ামী লীগের পাঁচজন, মগ পার্টি থেকে জেএসএস-লারমায় যোগদানকারী একজন এবং একজন সাধারণ মানুষ নিহত হন। আর সর্বশেষ মঙ্গলবার নিহত হলেন জেএসএস-লারমার তিন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ছয়জন।