২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাড়ির দেয়ালে অপরাধের বিবরণ লিখছে বিজিবি

বিজয়নগর উপজেলার কাশিনগর গ্রামের একটি দেয়ালে লেখা হচ্ছে ‘ইয়াবা ব্যবসায়ীর বাড়ি’। গত ২৩ সেপ্টেম্বরের ছবি।  প্রথম আলো
বিজয়নগর উপজেলার কাশিনগর গ্রামের একটি দেয়ালে লেখা হচ্ছে ‘ইয়াবা ব্যবসায়ীর বাড়ি’। গত ২৩ সেপ্টেম্বরের ছবি। প্রথম আলো

‘ইয়াবা ব্যবসায়ীর বাড়ি’। ‘মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি’। ‘মানব পাচারকারীর বাড়ি’। বাড়ির বাইরের দেয়ালে লাল ও সাদা রং দিয়ে এসব লেখা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলার সাতটি বাড়িতে এমন অপরাধের বিবরণ লিখছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। 

বাড়িগুলো ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা আন্তসীমান্তসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অপরাধীর, বিশেষ করে মাদক কারবারিদের শনাক্তের উদ্যোগে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন বাড়ি শনাক্ত করে সেখানে তাদের অপরাধসংক্রান্ত তথ্য লিখে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে সামাজিকভাবে লজ্জিত হওয়ার ভয়ে নতুন করে কেউ এমন অপরাধে জড়াবে না এবং জড়িত ব্যক্তিরাও অপরাধ থেকে সরে আসবে বলে বিশ্বাস বিজিবির। 

বিজিবির আখাউড়ার আজমপুর সীমান্ত ফাঁড়ি সূত্রে জানা গেছে, ৮ সেপ্টেম্বর বিজিবির সদস্যরা আজমপুরের সীমান্তবর্তী রাজাপুর গ্রাম থেকে ২০ বোতল ভারতীয় একধরনের সিরাপ (মাদক হিসেবে নেওয়া হয়), ১৪ বোতল ফেনসিডিলসহ জুয়েল মিয়াকে আটক করে। একই দিনে বিজয়নগর উপজেলার সিংগারবিল ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কাশীনগর গ্রামের রবিউল হোসেনকে ৪০০ ইয়াবাসহ আটক করা হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর আজমপুর থেকে ১৩ বোতল সিরাপসহ একই উপজেলার কোড়াতলি গ্রামের হুমায়ূন কবিরকে আটক করা হয়। দুদিন বাদে ২০ বোতল সিরাপসহ ইছহাক মিয়া নামের আরেক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়।

এ ছাড়া বিজয়নগর উপজেলায় গত ২১ সেপ্টেম্বর সিংগারবিল রেলগেট এলাকা থেকে দুই কেজি গাঁজাসহ ইনসাফ আলী নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত ২৪ জুলাই রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঘাগুটিয়া এলাকার ২০১৮ মেইন সীমান্ত পিলার এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পাচারের সময় ঘাগুটিয়া বিজিবি ক্যাম্পের টহলরত সদস্যরা নাইজেরিয়ার তিন নাগরিককে আটক করেন। ঘাগুটিয়া গ্রামের মোশাররফ হোসেন বিদেশি নাগরিকদের ভারতে পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য পাওয়া যায়।

এই সাতজনের বাড়ির দেয়ালে অপরাধের ওই বিবরণ লিখে দেওয়া হয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সরেজমিনে এর সত্যতা মিলেছে। এভাবে বাড়ি শনাক্ত করা এবং সামাজিকভাবে বর্জন করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অপরাধ থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব বলে মত বিজিবির কর্মকর্তাদের। তবে নাগরিক সমাজের সদস্যদের মতে, এই উদ্যোগ বরং নেতিবাচক ফল আনবে। পুরো পরিবার সামাজিকভাবে হেয় হবে। অপরাধীদের সৎ জীবনে ফিরে আসা আরও কঠিন করে তুলবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাগরিক ফোরামের সভাপতি পিযুষ কান্তি আচার্য প্রথম আলোকে বলেন, একজন মাদক ব্যবসায়ীর জন্য তার পুরো পরিবারকে কেন হেয়প্রতিপন্ন হতে হবে? এটি লেখার কারণে তার পরিবারের কেউ সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। দায় পুরো পরিবারকে কেন নিতে হবে? যেসব বাড়িতে এমন কথা লেখা থাকবে, সেখানকার শিশু-কিশোরদের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সদস্য ও জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য নাসির মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, মাদকসহ কেউ ধরা পড়লে বাড়ির দেয়ালে এসব লিখে দেওয়াটা মোটেও যৌক্তিক নয়। কারণ, ওই বাড়িতে অন্যরাও বসবাস করে। কাউকে হেয়প্রতিপন্ন বা অপমান করা আইনত নিষেধ। যে অপরাধ করবে, আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ২৩ সেপ্টেম্বর আখাউড়ার আজমপুরের রাজাপুর গ্রামের জামাল চৌধুরী, ইছহাক মিয়া, জুয়েল মিয়া, বিজয়নগর উপজেলার কাশীনগর গ্রামের রবিউল হোসেন ও সিংগারবিল গ্রামের ইনসাফ আলীর বাড়ির দেয়ালে ‘মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি’ কিংবা ‘ইয়াবা ব্যবসায়ীর বাড়ি’ লিখে দিয়ে আসেন বিজিবির সদস্যরা। আর আখাউড়ার মোশাররফ হোসেনের টিনের ঘরে বড় অক্ষরে ‘মানব পাচারকারীর বাড়ি’ লিখে দেওয়া হয়।

সীমান্তের প্রায় ৫০০ গজ ভেতরে কাশীনগর গ্রামে রবিউলের বাড়ি। তাঁর মা মাহমুদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। সহজ-সরল। মাদকের কারবারে জড়িত নন। কেউ হয়তো তাঁর ছেলের হাতে মাদক দিয়ে ফাঁসিয়েছে। সিংগারবিল গ্রামের ইনসাফ আলীর বাবা মন্নান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে সঙ্গ দোষে পড়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। তাই সন্তানকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন তিনি। মন্নান বলেন, ‘ছেলের এই দুষ্কর্মের জন্য এলাকায় মুখ দেখাতে পারছি না। এর ওপর আবার বাড়ির সামনে এমন সব কথা লেখা হয়েছে, যা আমাদেরকে এলাকায় আরও অপদস্থ করবে।’

এলাকাবাসী বলছেন, যাঁদের বাড়িতে এসব লেখা হয়েছে, তাঁদের জন্য এটি লজ্জার বিষয়। এ জন্য তাঁরা এলাকায় হেয়প্রতিপন্ন হবেন। সবাই তাঁদের ঘৃণার চোখে দেখবে। মানুষ তাঁদের সঙ্গে মিশতে চাইবে না। বাড়ির একজন সদস্য হয়তো কোনো কারণে অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু তাঁর জন্য বাড়ির সবাই ভুক্তভোগী হবেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

জানতে চাইলে সরাইলে বিজিবির ২৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল গোলাম কবির বলেন, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে কোনো মানব পাচারকারী, মাদক ব্যবসায়ী আটক হলেই তাদের বাড়িতে এসব লিখে দেওয়া হবে। সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে অপরাধীদের নিরুৎসাহিত করতে এবং সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীদের কারণে অনেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পথে বসেছে। যে মাদক ব্যবসা করছে, এর দায় তাকেই নিতে হবে। আমরা চাই তারা সুপথে ফিরে আসুক।’