২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ফাঁসির আসামির পিছু পিছু

‘না আপা তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়নি, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, আর তাই আমরা তাঁকে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’

‘এমন কি আগেও হয়েছে?’

কারাগার থেকে বেরিয়ে এলাকায় রাজনৈতিক জনসংযোগে ব্যস্ত আসলাম ফকির। ছবি: প্রথম আলো
কারাগার থেকে বেরিয়ে এলাকায় রাজনৈতিক জনসংযোগে ব্যস্ত আসলাম ফকির। ছবি: প্রথম আলো

‘না, এমন আগে কখনো হয়নি।’ বলেই খট করে ফোন রেখে দিলেন কারা কর্মকর্তা। কিছুটা বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম, যে রাতে ফাঁসি, সেই রাতেই আসামি অসুস্থ হন কী করে? আসলে কী হয়েছিল? খুঁজতে লাগলাম ওই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির অতীত, ক্ষমতার উৎস।

এর আগের দিনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জেনে এসেছিলাম আসলাম ফকির নামের এই কয়েদি ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগের দিন ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ করেছিলেন, তাই তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়নি। মন্ত্রণালয়ের সব কক্ষে ঢুঁ মারা আমার প্রতিদিনের কাজ। সেদিনও একইভাবে প্রতিবেদনের বিষয় খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে একটি কক্ষে গিয়ে বসলাম। কারা–শাখার কর্মকর্তারা ওই খুনির ফাঁসি না হওয়া নিয়ে কানাঘুষা করছিলেন। কিন্তু তাঁরা আমাকে কোনো তথ্য দিতে রাজি হলেন না। 

মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সচিব সবার কাছেই এ বিষয়ে খোঁজ নিলাম। কেউই কিছু করতে চাইলেন না। অবশেষে এক কর্মকর্তা বললেন, ‘যা করার তা ঊর্ধ্বতনরাই করেছেন। বুঝতে পারছেন না!’ (প্রাণ ভিক্ষা করতে হলে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাগে)।

আসলে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আসলাম তেমন কোনো বড় নেতাও নন। কোন পরিচয় তাঁকে ফাঁসি থেকে ফিরিয়ে আনল? কেন কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না?

 নানা প্রশ্ন আমার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। কীভাবে জানব কে এই আসলাম ফকির? কে কথা বলবে? কার কাছে যাব তথ্যের জন্য? 

সেদিন সচিবালয় থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেরোনোর সময় হঠাৎ সমনে পড়ল, আরে, এই খুনিকে নিয়ে তো বোধ হয় আমি তিন বছর আগেও এমন একটি প্রতিবেদন করেছিলাম! উফ্‌, যাক বাবা শেষ পর্যন্ত একটা ক্লু পাওয়া গেল। আমার তর সইছিল না। অফিসে ফেরার পথেই গুগলে আসলাম ফকিরের নাম লিখে খুঁজতে লাগলাম। বের হয়ে এল আমার তিন বছর আগের খবরটি। তিন বছর আগে খুনি আসলাম ফকির যখন প্রথম প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন, তখন আমি তাঁকে নিয়ে লিখেছিলাম ‘প্রাণভিক্ষা চেয়ে খুনি আসলামের আবেদন’। তবে সে সময় আবেদন নাকচ হয়। স্থানীয় জনপ্রিয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউটি) চেয়ারম্যান সাহেদ আলী হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আসলাম। ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন এই খুনি।

কিন্তু আমি যে প্রতিবেদনটি তৈরি করতে চাইছি তার জন্য আমার অনেক রসদ দরকার। পাব কি পাব না এমন দোলাচল নিয়ে কাজ শুরু করলাম।

এরই মধ্যে কারাগারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললাম। যোগাযোগ করলাম আদালতে, মন্ত্রণালয়ে, ফরিদপুরে। অফিসের অনুমতি নিয়ে চলে গেলাম কাশিমপুরে। গিয়ে খোঁজখবর করে জানতে পারলাম, নির্দিষ্ট দিনে তাঁর জন্য ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছিল। রেওয়াজ অনুযায়ী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে উপস্থিত হতে বলেছিল কারা কর্তৃপক্ষ। আগের দিন হঠাৎ করে ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ শুরু করেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ওই দিনই প্রাণভিক্ষার দ্বিতীয় আবেদন করা হয় রাষ্ট্রপতি বরাবর। তিন মাস পর আবেদন গৃহীত হয়। ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করে তাঁর সাজা ১৪ বছরের কারাভোগে নামিয়ে আনেন রাষ্ট্রপতি। 

আসলাম ফকিরকে ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে রেহাই দেওয়া, এমনকি কারাগার থেকে তাঁকে মুক্ত করতে কর্তৃপক্ষের বিশেষ তৎপরতা দৃশ্যমান হয়েছে। কেননা, তাঁর সাজা মওকুফের আবেদন করা হয়েছে দুবার। প্রথমবার সেটা নাকচ হয়েছিল, দ্বিতীয়বার গৃহীত হয়। এ ছাড়া বিশেষ দিবসে বন্দীদের সাধারণ ক্ষমালাভের সুযোগ নিয়ে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্যও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) দিয়েছেন সাংসদ নিলুফার জাফর উল্যাহ। তবে তাঁর অনুরোধও সে সময় কাজে দেয়নি। কিন্তু অস্বাভাবিক আচরণের ছুতোয় ও প্রভাবশালীদের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত তাঁর সাজা মওকুফ করা হয়। 

সার্বিক বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করলাম ২০১৬ সালের ৯ মে। ‘ফাঁসির দড়ি সরিয়ে নেওয়া হলো মাত্র এক দিন আগে’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলো প্রথম পাতায়। এরপর থেকেই আমি নিয়মিত খোঁজ রাখতাম আসলাম ফকিরের কী অবস্থা। কবে ছাড়া পাবে? জানতে পারলাম ২০১৭ সালের জুলাই–আগস্ট মাসে তিনি মুক্তি পেতে পারেন।

যখনই কারাগারে ফোন করে জানতে চাইতাম আসলাম ফকিরের কী খবর, তখন তিনি খুব ভালো আছেন বলে জানাতেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার মিজানুর রহমান। ফাঁসি কার্যকর করার আগে আসলাম ফকির অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে একদিন তিনি বলেন, ‘একটু পরে মারা যাচ্ছে শুনলে যে কারও অসুস্থ হওয়াই স্বাভাবিক।’

ভাবলাম, আচ্ছা, আসলাম ফকিরের পরিবারের কেউ কি দেখতে যান না তাঁকে? পেলাম তাঁর মামা রাজ্জাক মাতুব্বরের নম্বর। ওই দিনই তিনি জেল থেকে আসলামকে দেখে ফিরেছেন বাড়িতে। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন আসলাম ফকির? জানালেন, খুব ভালো। অপেক্ষা করছেন বাড়ি ফেরার।

প্রতি সপ্তাহেই আমি খোঁজ নিতাম আসলাম ফকির ছাড়া পেলেন কি না। ফরিদপুর প্রতিনিধিকেও বলতাম খোঁজ নিতে। এরই মধ্যে জানতে পারলাম ফাঁসি মওকুফের পাশাপাশি ‘ভালো’ আচরণের কারণে ১৪ বছরের কারাদণ্ডে ১ বছর ১ মাস ১৩ দিন রেয়াতও পেলেন। আসলাম ফকির কারাগারে থাকা অবস্থায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন করলাম অনলাইনে, ‘ফাঁসি মওকুফের পর রেয়াতও পেলেন যুবলীগ নেতা আসলাম’।

এরপর এল সেই দিন। ২৫ আগস্টছাড়া পেলেন আসলাম ফকির। সোর্স জানাল, ছাড়া পেয়েই তিনি হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তিন দিন পর বাড়ি ফিরে গেছেন। সেদিনই কোনো প্রতিবেদন না লিখে খোঁজ নিতে থাকলাম বাড়ি ফিরে তিনি কী করেন। প্রায় এক সপ্তাহ পর ফরিদপুরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সাংসদ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ ও তাঁর স্ত্রী সাংসদ নিলুফার জাফর উল্যাহর সঙ্গে এলাকার নানা কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে আসলাম ফকিরকে। তাঁর সাজা মওকুফের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে এ দুজন ভূমিকা রেখেছিলেন। আসলামের ইচ্ছা এখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করার এবং আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার। তাই তিনি জোরেশোরে কাজে নেমেছেন। খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিয়ে।
মোবাইল ফোন নম্বর জোগাড় করে আসলাম ফকিরকে ফোন দিয়ে জানালাম আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে চাই। বিনয়ে গদগদ হয়ে ধন্যবাদ জানালেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কারাগারে থাকাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, এ জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়নি। কী সমস্যা হয়েছিল?’ জবাবে বললেন, ‘আরে আপা, অসুস্থ ছিলাম না কারাগারে। ফাঁসির দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাওয়ায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। পরদিন দেখি, ফাঁসি বাতিল হয়ে গেছে!’ জানতে চাইলাম, ‘আপনাকে সাজা মওকুফ পেতে কারা সহায়তা করল?’ আসলাম ফকির বললেন, ‘কে আর করবে? লিডার কাজী জাফর উল্যাহ ও তাঁর স্ত্রী সাংসদ নিলুফার জাফর উল্যাহ। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা কী পারেন।’ শারীরিক ও মানসিক অবস্থা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ আছেন। অনেকগুলো হাসপাতালে চেকআপ করিয়েছেন, কোনো সমস্যা নেই। এখন ব্যস্ত জনসংযোগ নিয়ে।
ফোন রাখার আগে আমাকে অনুরোধ জানিয়ে বললেন, ‘আপা, যদি পারেন আমার জন্য পাত্রী দেইখেন, বয়স হয়ে গেছে, সঙ্গী দরকার।’
পরদিন ফরিদপুর প্রতিনিধিকে তাঁর জনসংযোগের কিছু ছবি পাঠাতে বললাম। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, আসলামের বাড়িতে দর্শনার্থীর ভিড় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। তিনি যখন বাইরে বের হন, তাঁর সঙ্গে থাকে মোটরসাইকেলের বহর। ১৭ সেপ্টেম্বর কাজী জাফর উল্যাহর সঙ্গে সদরপুর ও চরভদ্রাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন আসলাম ফকির। ফোনে কাজী জাফর উল্যাহর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি জানালেন, বিষয়টি রাজনৈতিক, তাই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলবেন না।
সর্বশেষ মুখ খুললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘সে তো মানসিক রোগী ছিল। এ জন্যই তাকে ক্ষমা করা হয়েছে। এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে, জনসংযোগ করছে, কী বলেন? খোঁজ নিতে হবে তো! এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
এসব নিয়েই গত ২৪ সেপ্টেম্বরপ্রকাশিত হয় ‘ফাঁসির দড়ি থেকে রাজনীতির মাঠে’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি। প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে আসলাম ফকির আর ঘর থেকে বের হন না। কেউ গেলেই বলছেন, ‘মিথ্যা নয়, তিনি এবার সত্যিই অসুস্থ।’