ফরহাদের ১৩ মিনিট এবং চট্টগ্রাম কারাগারের নিরাপত্তা
চার দিন আগে বন্দী ফরহাদ পালানোর ঘটনায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, তিনি পালানোর আধা ঘণ্টা পর পর্যন্ত বিষয়টি টের পায়নি কারা কর্তৃপক্ষ। এই সময়ের বাইরে ওই বন্দী বিশেষ ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে আরেকটি ভবনের চারতলা পর্যন্ত যেতে সময় নিয়েছেন ১৩ মিনিট। তখনো বিষয়টি কারও নজরে আসেনি। এর আগে খুন ও রহস্যময় মৃত্যুসহ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে এই কারাগারে। এরপরও সতর্ক না হয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢিলেঢালা রাখারই অভিযোগ উঠছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
গত শনিবার (৬ মার্চ) ভোর ৫টা ১৬ মিনিটে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্ণফুলী ভবনের পঞ্চম তলার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বের হন হত্যা মামলার আসামি ফরহাদ হোসেন ওরফে রুবেল। মঙ্গলবার তাঁকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ফরহাদ এর আগে আরও দুবার পালানোর চেষ্টা করেন।
ফরহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ভোর সোয়া পাঁচটায় বিশেষ ওয়ার্ডের তালা খোলার পর ফরহাদ কারাগারের কর্ণফুলী ভবনের নিচে নেমেছিলেন। এরপর প্রায় ২০০ গজ দূরে সংস্কারাধীন ৩২ নম্বর সেল ভবনের কাছে যান। ওই ভবনটি দোতলা থেকে পাঁচতলা করা হচ্ছে। ৩২ নম্বর সেল ভবনের মূল দরজা বন্ধ থাকায় তিনি জানালার গ্রিল দিয়ে দ্বিতীয় তলায় ওঠেন। সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন চারতলার ছাদে। এরপর লাফ দিয়ে ৬০ ফুট ওপর থেকে গিয়ে পড়েন কারাগারের সীমানার ১৮ ফুট উঁচু দেয়ালের (প্যারা মিটার ওয়াল) বাইরে। ভবন থেকে ২২ ফুট দূরে এই দেয়ালের অবস্থান। একটু দূরে পাঁচ ফুট উঁচু আরেকটি সীমানাপ্রাচীর পার হয়ে ফরহাদ কারাগারের বাইরে যান। সেখান থেকে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে যান সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। ওই দিন ট্রেনে প্রথমে ঢাকা, পরে নরসিংদীতে ফুফুর বাড়িতে চলে যান।
ফরহাদের নিখোঁজের বিষয়টি ওই দিন সকাল ছয়টায় বন্দী গণনার সময় কারা কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এই হিসেবে ফরহাদের লাপাত্তার বিষয়টি আধা ঘণ্টা নজরের বাইরে ছিল কারা কর্তৃপক্ষের।
ওসি নেজাম বলেন, মানসিকভাবে শক্ত ও শারীরিকভাবে সক্ষম এই যুবক অভ্যাসগত ছিনতাইকারী। এর আগেও তিনি দুর্ধর্ষ অনেক কাজ করেছেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ না দেখলে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কথা নয়। নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতির কারণে তিনি পালাতে পেরেছেন বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ফরহাদকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁকে পালাতে কেউ সহযোগিতা করেছেন কি না, সব বের করা হবে।
ফরহাদ বর্তমানে চট্টগ্রাম কারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কারা হাসপাতালের চিকিৎসক শামীম রেজা বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, ফরহাদের পায়ের তালুতে জখম রয়েছে। প্লাস্টার করা হয়েছে। ৬০ ফুট উঁচু থেকে লাফ দিলেও ‘ভাগ্যক্রমে’ তেমন আঘাত লাগেনি।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দায়িত্বরত কারারক্ষী নাজিম উদ্দিন জানতেন না দুর্ধর্ষ বন্দীদের রাখা ওয়ার্ডের তালা খোলা যাবে না। তাঁকে সেখানে দায়িত্ব দেওয়ার আগে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। আবার কারাগারে ৪৮টি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক ও কারাধ্যক্ষ তাঁদের কক্ষে বসে সিসি ক্যামেরাগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। তাতেও চোখে পড়েনি কর্মকর্তাদের।
অবশ্য বন্দী পালানোর ঘটনার পরদিন চট্টগ্রাম কারাগারের কারাধ্যক্ষ (জেলার) রফিকুল ইসলাম ও উপকারাধ্যক্ষকে (ডেপুটি জেলার) আবু সাদ্দাতকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে কারারক্ষী নাজিম উদ্দিন ও মো. ইউনুসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এই দুই কারারক্ষীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কিছু বলতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি প্রিজন মো. ছগির মিয়া বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, কারারক্ষী তালা খুলে না দিলে বন্দী পালানোর সুযোগ পেতেন না। তা ছাড়া নির্মাণাধীন ওই ভবনে ওঠার সিঁড়ির মুখে পাহারা থাকলেও পালাতে পারতেন না। তদন্ত শেষে ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, ঢিলেঢালা নিরাপত্তাকে জোরদার করার সুপারিশ করা হবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে।
সাধারণত কারাগারে দুর্ধর্ষ বন্দীদের কর্ণফুলী ভবনের পঞ্চম তলার ১৫ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাখা হয়। অন্য বন্দীরা (জঙ্গি ছাড়া) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ওয়ার্ড থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেলেও দুটি ওয়ার্ডের বন্দীরা সে সুযোগ পান না। তাঁদের কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। দিনরাত তালাবদ্ধ থাকে দুটি ওয়ার্ড।
কারা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সাত হাজার বন্দী রয়েছেন। ধারণক্ষমতা রয়েছে ১ হাজার ৮৫৩ বন্দীর। এর মধ্যে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ ২০০ বন্দী রয়েছেন।
সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বপরায়ণ কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিয়োগে প্রাধান্য না দেওয়ার কারণে কারাগারে অনিয়ম ঘটছে বলে মনে করেন কারা অধিদপ্তরের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা টাকা দিয়ে আসেন, তাঁরা এগুলো তোলায় ব্যস্ত থাকে। কার, কী দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছেন, তদারকির সময় থাকে না। এতে ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, দায়িত্ব পালনে গাফিলতি থাকে। চট্টগ্রামের মতো বড় কারাগারে খুন, বন্দী পালানোর ঘটনা বিস্ময়কর। এসব ঘটনার জন্য যাঁরা দায়ী, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাঁদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
আগের যত অভিযোগ
এর আগে ২০১১, ২০১২ ও ২০১৫ সালে আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে ও জাল জামিননামার মাধ্যমে তিন বন্দী চম্পট দেন। আর দুজন কারাগার থেকে পালানোর চেষ্টাকালে ধরা পড়েন। কারাগারের ভেতরে রহস্যময় তিন মৃত্যুর পেছনে কারা জড়িত, তা–ও অজানা রয়ে গেছে। ১৯৯৮ সালে গলায় ব্লেড চালিয়ে যুবলীগ নেতা বলে পরিচিত মো. আলম, ২০০০ সালে ভারতীয় নাগরিক জিবরান তায়েবী হত্যা মামলার আসামি ওসমান ছুরিকাঘাতে ও ২০১৯ সালে সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী ইটের আঘাতে নিহত হন।
আলমের বড় ভাই মো. জাকির বলেন, ব্লেডটি কারাগারে ভেতর কীভাবে গেল? কারা সুযোগটি করে দিয়েছিল, তারা আজও চিহ্নিত হয়নি। এ ছাড়া এই কারাগারের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ গত ১ মার্চ রুপম কান্তি নাথ নামের এক বন্দীর স্ত্রী অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামীকে কারাগারে বৈদ্যুতিক শকসহ নানা নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক, কারাধ্যক্ষসহ চারজনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগে চট্টগ্রাম আদালতে মামলার আবেদনও করেন।