অস্ত্র আইনে মামলা
পুলিশের ভুলে আসামি, ছিলেন কারাগারেও
জাজিরা উপজেলার মতিসাগর গ্রামের স্বপনকে ধরে আনে পুলিশ। কিন্তু প্রকৃত আসামি স্বপন খানের বাড়ি একই উপজেলার হামগাঁও গ্রামে।
২০১২ সালের ১৬ মার্চের রাতে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার মতিসাগর গ্রামে দিনমজুর স্বপনের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরানো হয় হাতকড়া। স্বপন জানতে পারেন, তাঁর নামে ঢাকার গুলশান থানায় অস্ত্র আইনে মামলা আছে। এরপর ২৬ দিন জেল খেটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে বের হন স্বপন।
এই স্বপন কিন্তু অস্ত্র মামলার প্রকৃত আসামি নন। একই উপজেলার হামগাঁও গ্রামে আছেন আরেক স্বপন, তিনি স্বপন খান। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাই ও অস্ত্র আইনে ছয়টি মামলা রয়েছে। তাঁকে ধরতে গিয়ে পুলিশ ধরে নিয়ে আসে দিনমজুর স্বপনকে।
পুলিশের এই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে দিনমজুর স্বপন ও তাঁর পরিবারকে। পাঁচ বছর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন তিনি। মামলার খরচ জোগাতে ২টি গরু, ২৬ শতাংশ জমি বিক্রি করেছেন। কয়েকটি এনজিওর কাছে তাঁর ঋণ ১৫ লাখ টাকা। মামলার খড়্গ আর ঋণের চাপ—এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ২০১৭ সালে দেশ ছাড়েন তিনি। গত তিন বছর ধরে আছেন কুয়েতে।
মামলার নথি বলছে, ২০০৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার গুলশান এলাকায় ছিনতাই করার সময় চারটি গুলিভর্তি ইতালির তৈরি একটি অটোমেটিক পিস্তল, ম্যাগাজিনসহ আটক হন স্বপন খান। তিনি শরীয়তপুরের জাজিরার হামগাঁও গ্রামের নুরু খানের ছেলে। গুলশান থানায় অস্ত্র আইনে মামলার সময় নাম-ঠিকানার স্থানে স্বপন খান ওরফে সুমন, পিতার নাম আবদুল মালেক খান ওরফে নুরু খান ও গ্রাম মতিসাগর উল্লেখ করে। এই মামলায় অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামিন পান স্বপন খান। জামিনের পর পালিয়ে যাওয়ায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত স্বপন খানের পরিবর্তে দিনমজুর স্বপনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে পুলিশ।
বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে ঢাকার তখনকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক জাজিরা থানার কাছে প্রতিবেদন চান। জাজিরা থানা-পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যেকোনোভাবেই হোক, প্রথমে গ্রেপ্তার ব্যক্তি তাঁর প্রকৃত ঠিকানা গোপন করে অন্য ঠিকানা দেওয়ায় এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই নাম-ঠিকানা অনুযায়ী অভিযোগপত্র দেওয়ায় এই সমস্যার উদ্ভব হয়েছে।’ প্রতিবেদনে স্বপনকে নির্দোষ বলা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষও দুই স্বপনের ছবির মিল না পাওয়ার বিষয়টি জানায়। তখন আদালত দিনমজুর স্বপনকে জামিনে মুক্তি দেন।
ভুল করে ধরে আনা স্বপনের আইনজীবী ছাবিবা রনি বেগম বলেন, পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা নাম-ঠিকানা সঠিকভাবে যাচাই না করেই অভিযোগপত্র দিয়েছেন।
জামিন হলেও রেহাই পাননি
জামিনে মুক্তি পেলেও মামলার প্রতিটি ধার্য তারিখে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির হতে হয় স্বপনকে। ২২ নভেম্বর দিনমজুর স্বপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা হয় তাঁর বাবা, মা, স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে। স্ত্রী হাজেরা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী খেতখামারে কাজ করে সংসার চালাতেন। মামলা আর ঋণের চাপে স্বামীকে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
জাজিরা পৌরসভার সাবেক মেয়র আবুল খায়ের বলেন, নামের ভুলে মামলা টানতে গিয়ে পরিবারটি সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে এখন নিঃস্ব।
প্রকৃত আসামি স্বপনের মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে ঢাকায় থাকেন। টেলিফোনে তাঁর স্ত্রী হাছিনা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী ২০১৪ সালে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ছয় বছর ধরে রংপুর কারাগারে আছেন।
সে সময় মামলাটির তদন্ত করেছেন গুলশান থানার তখনকার উপপরিদর্শক আবদুল মতিন। তাঁকে পাওয়া যায়নি। গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা কীভাবে নাম-ঠিকানা যাচাই করেছেন, তা এখন বলা যাচ্ছে না। তবে আদালত চাইলে আবার তদন্ত করে প্রতিবেদনের মাধ্যমে সব বিভ্রাট দূর হবে।