পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের ওপর হামলা, তদন্ত কমিটি
আহমদিয়া মুসলিম জামাতকে (কাদিয়ানিদের) অমুসলিম ঘোষণা ও পঞ্চগড়ে পূর্বঘোষিত বার্ষিক সম্মেলন বন্ধের দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার রাতে তাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া একই দাবিতে পঞ্চগড় শহরে বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) এহেতেশাম রেজাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের ভাষ্য, গতকাল রাত ৯টা থেকে রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত পঞ্চগড় শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়ক বন্ধ করে রাখে কাদিয়ানিবিরোধী জনতা। তারা মিছিল করে শহরের করতোয়া সেতু পার হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় শহরে যান চলাচলে অচলাবস্থাসহ ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও রাবার বুলেট ছুড়ে অবরোধ ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। একই সময়ে পঞ্চগড় শহর থেকে বিক্ষুব্ধ লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে শহরের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে করতোয়া নদী পার হয়ে আহমদনগর এলাকায় জলসার জন্য প্রস্তুতকৃত প্যান্ডেল, বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর করতে যায়। এ সময় পাঁচটি বাড়ি ও বাড়িসংলগ্ন দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধরা। এসব ঘটনায় অন্তত ৪০ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ জনই পুলিশ সদস্য। আহত পুলিশ সদস্যদের সবাই চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। তবে বাকি আহতদের মধ্যে তিনজনকে পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে এবং পাঁচজনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে পঞ্চগড় ও আহমদনগর এলাকায় পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গতকাল রাত সোয়া ১১টার দিকে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ গোলাম আজম পঞ্চগড় বাজার জামে মসজিদের মাইকে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে ঘোষণা করেন, আহমদিয়া মুসলিম জামাতের ঘোষিত জলসা জেলা প্রশাসন স্থগিত করেছে।
ঘটনার পরপর রাতেই রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আবদুল্লাহ সাজ্জাদ, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মজিদ আলী, জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন ও পুলিশ সুপার মো. গিয়াসউদ্দিন আহমদ, পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মহিউস সুন্নাহ, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) এহেতেশাম রেজা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাঈমুল হাছানসহ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তাঁরা পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের দেখতে যান। এ সময় তাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
প্রসঙ্গত, ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের আহমদনগর এলাকায় তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনের ডাক দেয় আহমদিয়া মুসলিম জামাত। এই জলসাকে কেন্দ্র করে এক সপ্তাহ ধরে সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ, ঈমান আকিদা রক্ষা কমিটি, স্থানীয় তৌহিদি জনতা ও ইসলামী যুবসমাজের ব্যানারে দফায় দফায় আন্দোলনে নামে পঞ্চগড়ের বিক্ষুব্ধ কিছু লোকজন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সন্ধ্যার পর আন্দোলনকারীদের নেতাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের একটি বৈঠকে কাদিয়ানিদের জলসাটি স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়। তবে এই খবর পঞ্চগড় শহরের চৌরঙ্গী এলাকায় পৌঁছানোর আগেই সেখানে বিক্ষোভ মিছিলসহ মহাসড়ক অবরোধ করা হয়।
এ ব্যাপারে সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদের সদস্যসচিব ও পঞ্চগড় ঈমান আকিদা রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কারি মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘গতকাল সন্ধ্যার পর প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের সভায় কাদিয়ানিদের জলসাটি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই খবরটি নিয়ে আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে শহরের চৌরঙ্গী এলাকায় এসে ঘোষণা দিই। আমাদের সেই ঘোষণা বিক্ষুব্ধ লোকজন মানছিল না। প্রশাসন ও আমরা অনেক চেষ্টা করেছি তাদের নিবৃত্ত করার, কিন্তু পারিনি। পরে বিষয়টি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে এ ঘটনার সৃষ্টি হয়।’
পঞ্চগড় সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা প্রতীক কুমার বণিক বলেন, হাসপাতালে পুলিশসহ ৪০ জন রোগী এসেছিলেন। ২০ জন পুলিশসহ মোট ৩২ জন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। অপর আটজনের মধ্যে পাঁচজনকে রংপুরে মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। আর তিনজন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
পঞ্চগড় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু আককাস আহমদ বলেন, গতকাল রাতের ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের পক্ষ থেকে ৫১টি রাবার বুলেট ছোড়া হয় এবং কাঁদানে গ্যাসের ১৭টি শেল নিক্ষেপ করা হয়।
পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমদ বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করেই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আহমদনগর এলাকায় বর্তমানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘মুসল্লিদের দাবি ছিল কাদিয়ানিদের জলসা বন্ধ করলে তারা তাদের দাবিদাওয়া তুলে নেবে। আমরা তাদের জলসা স্থগিত করার ঘোষণা দিই। তারপরও তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’